শ্রী নিখিলনাথ রায়
সেই অনুগ্রহবলে তাঁহারা অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমগ্র ভারতবর্ষের এক অভাবনীয় কাণ্ডের অবতারণা করিয়া গিয়াছেন। বাদসাহ-নবাব হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা জমীদার পর্যন্ত তাঁহাদের অজস্র অর্থবৃষ্টিতে অভিষিক্ত হইয়া উঠিতেন। বৈদেশিক ইংরেজফরাসীগণ তাঁহাদের বিনা অনুগ্রহে বাণিজ্যকার্য্যপার- চালনে সমর্থ হইতেন না; মুর্শিদাবাদের নবাবগণ সর্ব্বদাই তাঁহাদের মুখাপেক্ষা করিতেন এবং তাঁহাদের বলে বলী হইয়াই সমস্ত জগতে মুর্শিদাবাদের গৌরবঘোষণা করিতে সাহসী হইয়াছিলেন।
কি বাণিজ্য, কি রাজস্ব, সমস্ত বিষয়ই সেই ধনকুবেরগণের সাহায্য বাতীত কদাচ সম্পন্ন হইত না। ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যা তাঁহাদের পরামর্শের উপর নির্ভর করিত। তাঁহাদের কথায় নবাবের নবাবী রহিয়াছে, আবার তাঁহাদের ইঙ্গিতে নবাবের নবাবী গিয়াছে। তাঁহাদের কটাক্ষমাত্রেই বাঙ্গলার তৎকালীন রাষ্ট্রবিপ্লবসমূহ সংঘটিত হইয়াছে।
যে ভয়াবহ বিপ্লবে মুসস্থান রাজত্বের অবসান ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়, যাহার দিদাহকারী অগ্নিকাণ্ডে হতভাগ্য সিরাজ পতঙ্গবং ভস্মীভূত হইয়া যান, এবং মীরজাফর ও মীরকাসেম বিশেষ রূপে দগ্ধ হইয়া, কেহ অনন্তধাম কেহ বা ফকিরীপথ আশ্রয় করিয়া, শান্তি লাভ করিতে সমর্থ হন, তাহারও মূলে জগৎশেঠদিগের অমোঘ শক্তি নিহিত ছিল। অর্থ ও প্রাণ দিয়া তাঁহারা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়া গিয়াছেন।
তাই আজ ব্রিটিশ রাজলক্ষ্মীর উজ্জল মুকুটপ্রভা সমুদায় ভারতবর্ষ আলোকিত করিয়া, সসাগরা বসুন্ধরাকে প্রভামন্ত্রী করিবার জন্য অবিরত ধাবিত হইতেছে। এক জন ঐতিহাসিক বলিয়াছেন যে, হিন্দু মহাজনের অর্থ ও ইংরাজ সেনাপতির তরবারি বাঙ্গলায় মুসল্যান রাজত্বের বিপর্যয় ঘটাইয়াছে।
বাস্তবিক জগৎশেঠগণ অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙ্গলার সমুদায় রাজ- নৈতিক ব্যাপারেরই মূল ছিলেন। রাজস্ববিষয়ে জমীদারদিগের সহিত তাঁহাদেরই সম্বন্ধ ছিল, বাণিজ্যবিষয়ে তাঁহারাই তত্ত্বাবধান করিতেন। এতদ্ভিন্ন শাসনকার্য্য তাঁহাদের পরামর্শ ব্যতীত কদাচ নির্বাহিত হইত না। রাজ্যের মুদ্রা তাঁহাদের মতানুসারে মুদ্রিত হইত।
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-২২)