১১:০১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৩১)

“ব্রাহ্ম প্রাণে প্রাণী হইয়া জীবিত অবস্থায় জীবন্ত জীবনে চলাই সত্য ধৰ্ম্ম, আর ও ব্রাহ্মনাম এই ধর্ম্মের মূল মন্ত্র।

কালীকাচ

উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে চৈত্রসংক্রান্তিতে পালিত হতো হিন্দুদের এক বিশেষ রিচ্যুয়াল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, “চৈত্রসংক্রান্তিতে ‘কালীকাচ’ ঢাকার একটি বিশেষ ব্যাপার। ব্যাটাছেলেরা কালী সেজে দু’হাতে দু’খান তলোয়ার নিয়ে বাড়ী বাড়ী নেচে বেড়াত। ‘কালীমাই’কে এরূপ যত্রতত্র নাচিয়ে তার মর্যাদা হয়তো রক্ষিত হতো না, কিন্তু নৃত্যকলার বিচক্ষণ চর্চা হতো। শিব ধরায় শায়িত, তাঁর বক্ষে একটি ছোট ফল স্থাপিত, নৃত্যরত কালী তরবারির এক ঘায়ে তা কেটে দু’টুকরো করে ফেলতেন, কিন্তু শিব ঠাকুরের ত্বকও স্পর্শ হতো না- ওস্তাদি কি কাম! নৃত্য ও ঢাকের বাদ্যে চৈত্র রাত্রি মুখরিত হয়ে উঠত।”

কালীনারায়ণ দত্ত (১৮৩০-১৯০৩)

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা/পূর্ববঙ্গে সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন কালীনারায়ণ দত্ত। পিতা সুধারাম সেন।ঢাকার মহেশ্বরদির ভাটপাড়ায় জমিদার মহেন্দ্রনারায়ন দত্ত ও ভাগরথী দেবী দত্তক নিয়েছিলেন কালীনারায়ণকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র চার। মহেন্দ্রনারায়ণের অকাল মৃত্যু হলে ভাগরথী দেবীর শোক প্রশমনে কালীনারায়ণকে দত্তক করে আনা হয়।

ছেলেবেলায় কালীনারায়ণ বাংলা সংস্কৃত যেমন পড়েছিলেন তেমনি ফার্সি, উর্দুও শিখেছিলেন। পরে ‘খুল্লতাত’ হরিশ্চন্দ্র রায়ের বাসায় ফার্সি শেখার সময় ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে তাঁর ইংরেজি শিক্ষা স্থগিত হয়। ফিরিয়ে আনা হয় তাঁকে গ্রামে।

কালীনারায়ণ দত্ত

মাত্র ১৩ বছর বয়সে কালীনারায়ণের বিয়ে হয় অন্নদার সঙ্গে। ১৭ বছর বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে শক্তি শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা নেন। ভাওয়ালের রাজা কালীনারায়ণ, মুড়াপাড়ার জমিদার ঈশান গুপ্ত প্রমুখ ছিলেন তাঁর শিষ্য।

অক্ষয় দত্তের ধর্থনীতি ও বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার বই দুটি পড়ে তাঁর মনে নানা প্রশ্ন জাগে। তিনি তখন ময়মনসিংহে যেখানে ঈশানচন্দ্র বিশ্বাসের কাছে এ ধরনের যেসব বই পাওয়া যেত সেগুলি পড়ে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে আরো আকৃষ্ট হন এবং ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত শুরু করেন। তাঁর বয়স যখন ২০-২৫ তখন নিয়মিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পড়া শুরু করেন। লিখেছিলেন, “ব্রাহ্ম প্রাণে প্রাণী হইয়া জীবিত অবস্থায় জীবন্ত জীবনে চলাই সত্য ধৰ্ম্ম, আর ও ব্রাহ্মনাম এই ধর্ম্মের মূল মন্ত্র। এই নামকে পরিত্রাণ দাতা জানিয়া অনন্ত উল্লাসে জীবন ভোগিয়া হাস্য কৌতুকে জীবন অতিপাত করাই মানব জীবনের লক্ষ্য।”

তারপর ১৮৬৯ সালে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। প্রথম মুসলমান জালালউদ্দিন যিনি ব্রাহ্ম হয়েছিলেন তাঁকে তিনিই ব্রাহ্মসমাজে নিয়ে আসেন। কালীনারায়ণ ঢাকা ও ভাটপাড়ায় দু’জায়গায়ই বসবাস করতেন। তাঁর জমিদারি কাওরাইদে তিনি ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করেন, যেখানে তিনি অনুরাগীদের নিয়ে উপাসনা করতেন।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে যেতেন। সঙ্গীত ছিল তাঁর খুব প্রিয়। অনেক গান রচনা করেছিলেন যেগুলি ভাবসঙ্গীত নামে ছিল পরিচিত। নিজের গান গেয়ে প্রচার করতেন। ব্রাহ্মধর্মে ভক্তি ছিল তাঁর প্রবল। যে ক’জন শেষ জীবন পর্যন্ত ব্রাহ্ম ছিলেন তিনি তাঁর অন্যতম। এ জন্য তাঁর নামের আগে ভক্ত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। প্রিভি কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় কাউন্সিলর ছিলেন তাঁর পুত্র কে. জি. গুপ্ত আই. সি. এস। সঙ্গীতকার অতুল প্রসাদ সেন ছিলেন তাঁর পৌত্র।

(চলবে)

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৩০)

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৩০)

 

 

সামান্য কমিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক রাখলেন ট্রাম্প, আগস্ট থেকে কার্যকর

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৩১)

০৭:০০:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫

“ব্রাহ্ম প্রাণে প্রাণী হইয়া জীবিত অবস্থায় জীবন্ত জীবনে চলাই সত্য ধৰ্ম্ম, আর ও ব্রাহ্মনাম এই ধর্ম্মের মূল মন্ত্র।

কালীকাচ

উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে চৈত্রসংক্রান্তিতে পালিত হতো হিন্দুদের এক বিশেষ রিচ্যুয়াল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, “চৈত্রসংক্রান্তিতে ‘কালীকাচ’ ঢাকার একটি বিশেষ ব্যাপার। ব্যাটাছেলেরা কালী সেজে দু’হাতে দু’খান তলোয়ার নিয়ে বাড়ী বাড়ী নেচে বেড়াত। ‘কালীমাই’কে এরূপ যত্রতত্র নাচিয়ে তার মর্যাদা হয়তো রক্ষিত হতো না, কিন্তু নৃত্যকলার বিচক্ষণ চর্চা হতো। শিব ধরায় শায়িত, তাঁর বক্ষে একটি ছোট ফল স্থাপিত, নৃত্যরত কালী তরবারির এক ঘায়ে তা কেটে দু’টুকরো করে ফেলতেন, কিন্তু শিব ঠাকুরের ত্বকও স্পর্শ হতো না- ওস্তাদি কি কাম! নৃত্য ও ঢাকের বাদ্যে চৈত্র রাত্রি মুখরিত হয়ে উঠত।”

কালীনারায়ণ দত্ত (১৮৩০-১৯০৩)

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা/পূর্ববঙ্গে সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন কালীনারায়ণ দত্ত। পিতা সুধারাম সেন।ঢাকার মহেশ্বরদির ভাটপাড়ায় জমিদার মহেন্দ্রনারায়ন দত্ত ও ভাগরথী দেবী দত্তক নিয়েছিলেন কালীনারায়ণকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র চার। মহেন্দ্রনারায়ণের অকাল মৃত্যু হলে ভাগরথী দেবীর শোক প্রশমনে কালীনারায়ণকে দত্তক করে আনা হয়।

ছেলেবেলায় কালীনারায়ণ বাংলা সংস্কৃত যেমন পড়েছিলেন তেমনি ফার্সি, উর্দুও শিখেছিলেন। পরে ‘খুল্লতাত’ হরিশ্চন্দ্র রায়ের বাসায় ফার্সি শেখার সময় ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে তাঁর ইংরেজি শিক্ষা স্থগিত হয়। ফিরিয়ে আনা হয় তাঁকে গ্রামে।

কালীনারায়ণ দত্ত

মাত্র ১৩ বছর বয়সে কালীনারায়ণের বিয়ে হয় অন্নদার সঙ্গে। ১৭ বছর বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে শক্তি শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা নেন। ভাওয়ালের রাজা কালীনারায়ণ, মুড়াপাড়ার জমিদার ঈশান গুপ্ত প্রমুখ ছিলেন তাঁর শিষ্য।

অক্ষয় দত্তের ধর্থনীতি ও বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার বই দুটি পড়ে তাঁর মনে নানা প্রশ্ন জাগে। তিনি তখন ময়মনসিংহে যেখানে ঈশানচন্দ্র বিশ্বাসের কাছে এ ধরনের যেসব বই পাওয়া যেত সেগুলি পড়ে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে আরো আকৃষ্ট হন এবং ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত শুরু করেন। তাঁর বয়স যখন ২০-২৫ তখন নিয়মিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পড়া শুরু করেন। লিখেছিলেন, “ব্রাহ্ম প্রাণে প্রাণী হইয়া জীবিত অবস্থায় জীবন্ত জীবনে চলাই সত্য ধৰ্ম্ম, আর ও ব্রাহ্মনাম এই ধর্ম্মের মূল মন্ত্র। এই নামকে পরিত্রাণ দাতা জানিয়া অনন্ত উল্লাসে জীবন ভোগিয়া হাস্য কৌতুকে জীবন অতিপাত করাই মানব জীবনের লক্ষ্য।”

তারপর ১৮৬৯ সালে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। প্রথম মুসলমান জালালউদ্দিন যিনি ব্রাহ্ম হয়েছিলেন তাঁকে তিনিই ব্রাহ্মসমাজে নিয়ে আসেন। কালীনারায়ণ ঢাকা ও ভাটপাড়ায় দু’জায়গায়ই বসবাস করতেন। তাঁর জমিদারি কাওরাইদে তিনি ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করেন, যেখানে তিনি অনুরাগীদের নিয়ে উপাসনা করতেন।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে যেতেন। সঙ্গীত ছিল তাঁর খুব প্রিয়। অনেক গান রচনা করেছিলেন যেগুলি ভাবসঙ্গীত নামে ছিল পরিচিত। নিজের গান গেয়ে প্রচার করতেন। ব্রাহ্মধর্মে ভক্তি ছিল তাঁর প্রবল। যে ক’জন শেষ জীবন পর্যন্ত ব্রাহ্ম ছিলেন তিনি তাঁর অন্যতম। এ জন্য তাঁর নামের আগে ভক্ত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। প্রিভি কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় কাউন্সিলর ছিলেন তাঁর পুত্র কে. জি. গুপ্ত আই. সি. এস। সঙ্গীতকার অতুল প্রসাদ সেন ছিলেন তাঁর পৌত্র।

(চলবে)

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৩০)

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৩০)