সারাংশ
- • খরচ বাড়লেও ডিমের দাম কম, আর মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের কারণে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন,
- • আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডিমের দামে আরও বড় উল্লম্ফনের আশঙ্কা রয়েছে,
- • টিসিবির হস্তক্ষেপ, এবং খাদ্য উৎপাদনে স্থানীয় উৎসে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন,
গত দশ মাসে দেশের প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি পোলট্রি খামার বন্ধ বা ধ্বংস হয়েছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি খামারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগামীতে ডিমের সরবরাহ মারাত্মকভাবে সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খামার বন্ধের প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিপরীতে কম দামে ডিম বিক্রির বাধ্যবাধকতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট।
বন্ধ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত খামারের বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমিতির (BPIF) তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসেই প্রায় ১০ হাজার ছোট-মাঝারি খামার বন্ধ হয়েছে। গত দশ মাস হিসেব করলে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। করোনা মহামারির ধাক্কায় পূর্বেই বন্ধ হওয়া প্রায় ৩৫ হাজার খামারের সঙ্গে এই নতুন সংখ্যাটি যোগ করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
গত দুই মাসে খামার মালিকদের প্রায় ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার ক্ষতির হিসেব দিয়েছে শিল্প সংশ্লিষ্টরা। উৎপাদন খরচ প্রতি ডিমে ১০ থেকে ১২ টাকা হলেও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ৬–৮ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি ডিমে লোকসান হচ্ছে ২–৪ টাকা।
ডিমের বাজারে ভবিষ্যৎ সংকট
খামার বন্ধ ও ধ্বংসের সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ডিমের বাজারে। কৃষক পর্যায়ে ডিমের দাম নিম্নগামী হলেও খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম ইতোমধ্যেই চড়া। বর্তমানে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬৮ টাকায় (প্রতি ডজন ১৬৫ থেকে ২০৪ টাকা)। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে সরবরাহ আরও কমলে এই দাম দ্রুত আরও বাড়তে পারে।
ডিম আমদানি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল, কিন্তু আমদানি করা হয়েছে সীমিত সংখ্যক ডিম। আমদানিকৃত ডিমের খরচ সবমিলিয়ে ৮.৫০ থেকে ১০.৫০ টাকা পড়লেও বাস্তবে এখনও এর সরবরাহ খুব সামান্য। দৈনিক বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডিমের চাহিদার তুলনায় আমদানিকৃত ডিমের সংখ্যা নগণ্য।
অন্যদিকে ডলারের রিজার্ভের অবস্থা বর্তমানে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২৬ থেকে ২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও এলসি খুলে ব্যাপকহারে ডিম আমদানির সক্ষমতা এখনও সীমিত। অতএব, আমদানির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি অস্থায়ী সমাধান হতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি নয়।
বাজার স্থিতিশীল করতে করণীয় কী?
বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা ডিমের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন:
- খামারিদের সহায়তা: সরকারিভাবে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য, স্বল্প সুদে ঋণ ও আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি।
- সীমিত আমদানি: ডলারের রিজার্ভ সঙ্কট মাথায় রেখে আমদানিতে নির্ভরশীলতা কমিয়ে জরুরি মুহূর্তে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমদানি সীমিত পর্যায়ে রাখা।
- বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি: মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, বাজার ব্যবস্থাপনায় টিসিবির সক্রিয় অংশগ্রহণ।
- স্থানীয় খাদ্য উৎপাদনে জোর: মুরগির খাবারের জন্য স্থানীয়ভাবে ভুট্টা, সয়াবিনসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদনে উৎসাহিত করা, যাতে আমদানি নির্ভরতা কমানো যায়।
বর্তমান অবস্থায় সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ডিমের বাজারে বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। আমদানির মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ডলারের সীমিত রিজার্ভের মধ্যে আমদানি করে দীর্ঘসময় বাজার সামাল দেওয়া অসম্ভব।
সুতরাং, সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ, খামারিদের সহায়তা ও বাজার নজরদারিই পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে।