জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নতুন বিতর্ক এবং সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনাগুলো উঠে এসেছে, তা দেশের আগামী দিনের সংবিধানিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর তিন নেতার বক্তব্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়—তারা তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বক্তব্য রাখলেও, প্রত্যেকেই একধরনের ব্যবস্থাগত সংস্কারের পক্ষে, তবে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং লক্ষ্যভিত্তিক অবস্থানের ভিন্নতা স্পষ্ট।
জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান তথা জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের চতুর্থতফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার ইঙ্গিত দিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী সংলাপ শেষে এ কথা জানান। এখানে তিনি ১৯৭১ সালের অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণার উদাহরণ টেনে সংবিধানে তার অন্তর্ভুক্তির রূপরেখা দিয়েছেন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ তুলনা। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়: প্রথমত, বিএনপি এই ঘোষণাপত্রের ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকার করে তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়, তবে সরাসরি সংবিধান সংশোধনের দাবিতে নয়—জাতীয় ঐকমত্যের শর্তসাপেক্ষে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি এই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া সরকার তুলে ধরেছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংশোধিত খসড়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা তাদের হালনাগাদ অবস্থান জানিয়েছে, যা বোঝায় যে তারা একরকম গঠনমূলক আলোচনায় নিয়োজিত, যদিও এর বাস্তবায়ন এখনো অনিশ্চিত।
এই অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিএনপি এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, অর্থাৎ সংবিধানে অংশগ্রহণমূলক ও সম্মতিপূর্ণ সংস্কারের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক চাহিদা উল্লেখ করছে না, বরং আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াগত পথ খুঁজে পাচ্ছে। বিশেষত, বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বাইরে রাখার চিন্তা এবং বিচারপতিদের শেষ বিকল্প হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব দেখায় যে বিএনপি একদিকে সহনশীল এবং অন্যদিকে বাস্তবনিষ্ঠ রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করছে। আবার প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের উল্লেখ—রাষ্ট্রপতির নির্বিচারে নিয়োগের ঝুঁকি কমাতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতির মধ্য থেকে একজন নিয়োগের প্রস্তাব—সামগ্রিকভাবে জবাবদিহিমূলক, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান তুলে ধরে।
জরুরি অবস্থার অনুচ্ছেদ ১৪১(খ) ও ১৪১(গ) সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির প্রস্তাব আরও ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত। তারা ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দটির অপব্যবহার নিয়ে সরাসরি উদ্বেগ জানিয়েছে এবং তার বদলে সাংবিধানিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির মতো কারণ অন্তর্ভুক্তির পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। এই প্রস্তাব সংবিধানের অপব্যবহার রোধে একটি ইতিবাচক ধারা প্রবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিএনপি জরুরি অবস্থার সময়েও জীবনের অধিকার ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষাকে অবিচ্ছেদ্য অধিকার হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলেছে। যদিও ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ বা গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে—এই বক্তব্যও দেখায় তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার ব্যবস্থার সীমাকেও বিবেচনায় নিয়েছে।
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন আরও একধাপ এগিয়েছেন; তিনি জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। এটি শুধুমাত্র ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি নয়, বরং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ের দাবি, যেখানে জুলাই ঘোষণাপত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এটি স্পষ্টত একটি র্যাডিক্যাল অবস্থান, যা বর্তমান সংবিধানের কাঠামোকে মূল থেকে পুনর্গঠনের প্রস্তাব রাখে। এখানে কেবল সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন নয়, পুরনো কাঠামো ভেঙে নতুন কাঠামো গঠনের অভিমুখে বিপ্লবী ধারাও লক্ষণীয়। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১১তম অধিবেশনের পর সাংবাদিকদের সামনে এনসিপি সদস্যসচিব এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
আখতার হোসেনের বক্তব্যে জরুরি অবস্থার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রেও কার্যকর বিধিনিষেধ ও স্বচ্ছতার দাবি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় নয়, বরং সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির অনুমোদনে রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা জারি করার প্রস্তাব একটি সুসংগঠিত সংসদীয় ব্যবস্থার লক্ষণ বহন করে। তারা বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইনগত বিধি ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলেছে, যা অতীতে দলীয় বিচারে করা নিয়োগের বিরুদ্ধে জবাবদিহিত্বের দাবি তোলে।
এখানে একটি সার্বিক বিশ্লেষণ জরুরি যে, এনসিপি যেখানে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রূপরেখা প্রকাশ করছে, সেখানে বিএনপি বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই সংস্কারের পথে অগ্রসর। এই দুই অবস্থানের ব্যবধান স্বাভাবিক, কারণ বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারে যাওয়ার সম্ভাব্য শক্তি ধরে রাখতে চায়, অথচ এনসিপি জন্য কাঠামোগত পুনর্গঠনই রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ বলে মনে হয়।
এবার জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের বক্তব্য—অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে, এমন অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘দিল্লির আধিপত্যবাদের কালো থাবা চতুর্দিক থেকে ছেঁয়ে বসেছে। ব্যবসা–বাণিজ্য, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক নীতি, কূটনীতি এমনকি সামনের নির্বাচন নিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কি করে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া যায়, সেই চক্রান্ত এখনো বিদ্যমান। আমাদের দেশে নির্বাচন আর সরকার পরিবর্তনের সময় এলে পরাশক্তির যে খেলা হয়, সেই খেলা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’ বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত ‘জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাংবাদিকের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভা এবং শহীদ সাংবাদিক পরিবারের সম্মাননা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। এখানে তিনি সংবিধান বা ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গে সরাসরি কোনো বিস্তারিত রূপরেখা উপস্থাপন না করে নির্বাচনী রাজনীতিকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও আধিপত্যবাদের ছায়ায় দেখার চেষ্টা করেছেন। তার বক্তব্যে দিল্লি ও অন্যান্য পরাশক্তির ‘খেলা’ নিয়ে সরাসরি অভিযোগ রয়েছে এবং তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগকে ফের নির্বাচনে আনার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে।
মিয়া গোলাম পরওয়ারের বক্তব্য অন্য দুই দলের তুলনায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক এবং কিছুটা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তিনি মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক চাপ ও ষড়যন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত বলে চিত্রায়িত করছেন। একদিকে স্বীকার করছেন যে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনকাল শেষ হয়েছে, অন্যদিকে আবার দাবি করছেন প্রশাসন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফ্যাসিবাদের দোসররা অবস্থান করছে। এ অবস্থানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্য করা যায়—যদি ফ্যাসিস্ট শাসন চলে গেছে, তবে অবকাঠামোগত সংস্কারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া উচিত, কিন্তু তিনি সেই পরিবেশের মধ্যেও ষড়যন্ত্রের ছায়া দেখছেন।
যাইহোক, গোলাম পরওয়ারের বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তিনি বারবার সতর্ক করছেন যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিকৃত করতে পারে। এই সতর্কতা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয়, বিশেষত ইতিহাসে আমরা ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের উদ্ভব এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির ছায়া প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু পরওয়ারের বক্তব্যে বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক রূপরেখা নেই—তিনি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দিচ্ছেন না, না নির্বাচনী কাঠামোর কোনো দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন; বরং রাজনৈতিক মেরুকরণ, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও সাধারণ ফ্যাসিবাদবিরোধী আবেগনির্ভর বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন।
এই তিন নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে পরিস্কার চিত্র পাওয়া যায়—জুলাই ঘোষণাপত্র এখন কেবল একটি রাজনৈতিক দলের দাবির বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের সম্ভাব্য নিয়ামক হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। বিএনপি এটিকে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে এবং বিদ্যমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই সংশোধনের মাধ্যমে দেখতে চায়। এনসিপি এটি পুরোপুরি নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে পরিণত করতে চায়। আর জামায়াত বা মিয়া গোলাম পরওয়ার আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে ‘ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ ও ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার আহ্বানে সীমাবদ্ধ রয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির মূল প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে—সংবিধান কি ধীরে ধীরে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হবে, না দলগত বিভাজন ও অভ্যন্তরীণ অনাস্থার কারণে এসব প্রস্তাব আরেকটি অপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতেই রয়ে যাবে? আবার সংবিধানিক সংস্কার কি কেবল নির্বাচনী কৌশলের অংশ, না কি আসলেই জনগণের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো উন্নয়নের প্রতি দায়বদ্ধতা বহন করবে?
তিন দলের বক্তব্যই একধরনের বাস্তব সংকেত দেয়। বিএনপি তুলনামূলকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবমুখী পথে এগোচ্ছে। এনসিপি দৃষ্টিভঙ্গে বাম-ধারার আদর্শবাদ যুক্ত করেও নতুন সংবিধানের দাবি দিয়ে আলোচনায় প্রবেশ করেছে। আর জামায়াত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বে আশ্রয় নিয়ে মূলধারার আলোচনার বাইরে নিজেদের একটি বিকল্প রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করছে।
শেষ পর্যন্ত সংবিধানিক সংস্কার ও জুলাই ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি আদৌ কোনো জাতীয় ঐকমত্যে রূপ নিতে পারবে কি না, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা এবং সর্বোপরি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও চাপ সৃষ্টির ক্ষমতার ওপর। অন্যথায়, এসব মন্তব্য হয়তো ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া আরও কিছু ঘোষণাপত্র বা অনুপস্থিত অধ্যায়ের মতো অতীতেই থেকে যাবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও খ্যাতিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক।