সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কিছু প্রচলিত সংবাদমাধ্যমে একের পর এক অভিযোগ প্রকাশিত হচ্ছে—বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। কখনো ছাত্র সংগঠনের পরিচয়, কখনো দলের কর্মী বা সমর্থক সেজে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চাপের মুখে পড়ছে।
চাঁদাবাজির ধরন ও পদ্ধতি
খবরে উঠে এসেছে—ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে দোকানদার, ছোট-বড় ব্যবসায়ী এমনকি স্বচ্ছল পেশাজীবীদের কাছে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। অনেকে আবার ‘ছাত্রনেতা’ বা ‘যুবনেতা’ পরিচয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে নগদ অর্থ আদায় করছে বা বিকাশ/নগদে টাকা নেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। কখনো সরাসরি হুমকিও দেওয়া হয়—চাঁদা না দিলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে বা দোকান ভাঙচুর করা হবে।
নতুন রাজনৈতিক দল NCP-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ
সাম্প্রতিক রিপোর্ট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় বিশেষ করে উঠে এসেছে নতুন গঠিত ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল NCP-এর নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির অভিযোগ। একাধিক জেলা ও উপজেলা শহরে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন—কিছু তরুণ নেতা ও তাদের অনুসারীরা নিজেদের NCP‘র নেতা বা কর্মী পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করছে। অনেক জায়গায় দোকানে গিয়ে সরাসরি নগদ অর্থ আদায় করা বা মোবাইল ট্রান্সফারে টাকা নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন—“ওরা বলছে, NCP নতুন দল, আমাদের সাপোর্ট করতে হবে। না দিলে ব্যবসা করতে সমস্যা হবে।” কেউ আবার বলেছেন—“ওরা ছাত্রনেতা বলে এলাকার ছেলেদের ভয় দেখিয়ে টাকা তোলে।”
প্রধানধারার কিছু মিডিয়ায় প্রকাশিত অভিযোগ
কিছু টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন—“আমরা কোনো রাজনৈতিক দল করি না, তবুও ওরা চাপ দিচ্ছে।” অনেকে পুলিশের কাছেও অভিযোগ করেছেন, কিন্তু ভয়ভীতির কারণে অনেকেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিতে দ্বিধায় থাকেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও ও স্ট্যাটাস
ফেসবুক লাইভে বা পোস্টে অনেকে চাঁদাবাজদের পরিচয় ফাঁস করার চেষ্টা করেছেন। কেউ ভিডিও প্রকাশ করে লিখেছেন, “দেখুন কিভাবে রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে চাঁদা তোলে।” তবে এই ভিডিও বা পোস্ট নিয়ে বিতর্কও হচ্ছে—যেসব দলের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেসব দলগুলোর নেতারা বলছেন—এগুলো ব্যক্তিগত অপকর্ম, দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
NCP নেতাদের অবস্থান
NCP-এর শীর্ষ নেতারা বলছেন—“কোনো অপরাধীকে দলীয় পরিচয় দিয়ে আমরা রক্ষা করবো না।” তারা দাবি করেছেন, এ ধরনের ঘটনায় যদি NCP নাম ব্যবহার হয়, তাহলে সেটি অপব্যবহার। দলের এক মুখপাত্র বলেন—“আমরা স্থানীয় কমিটিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছি—যদি কেউ চাঁদাবাজিতে জড়িত হয়, তাকে বহিষ্কার করতে হবে।”
বিরোধী প্রধান দলের (বিএনপি) প্রতিক্রিয়া
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেছেন—এ ধরনের চাঁদাবাজি রাজনীতির জন্য কলঙ্কজনক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন—“যে কোনো দল বা গোষ্ঠীর নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি বরদাশত করা যায় না। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।” বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন—“সব দলের উচিত নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং অপরাধীদের বের করে দেওয়া।”
ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব
দেশে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে এমন চাঁদাবাজির অভিযোগ ব্যবসায়ীদের আরও শঙ্কিত করছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন—রাজনৈতিক নাম জড়িয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় হলে বিনিয়োগের উৎসাহ কমে যায়। ছোট দোকানদার থেকে বড় উদ্যোক্তারা পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব
চাঁদাবাজি শুধু ব্যবসায়ী নয়, সাধারণ মানুষের জীবনকেও অস্বস্তিকর করে তুলছে। যেসব পরিবার কিছুটা স্বচ্ছল, তাদের বাড়ি গিয়ে বা ফোন করে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। অনেকে বলছেন—এতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন—রাজনৈতিক দলের পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি সমাজে ভয় ও অনাস্থা তৈরি করে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধ চক্রকে দমন না করলে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কিন্তু প্রমাণ সংগ্রহে সমস্যা হয়। অনেকেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিতে ভয় পান। আবার স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অভিযুক্তদের রক্ষা করতে তদবির করেন।
সমাধানের পথ
রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের শাখা ও অঙ্গসংগঠনগুলোতে শৃঙ্খলা জোরদার করতে হবে।
নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ করে নজরদারির মধ্যে আনতে হবে, যাতে তারা দায়িত্বশীল আচরণ করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা নিতে দিতে হবে।
চাঁদাবাজির ঘটনায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা দিয়ে অভিযোগ করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে রাজনৈতিক নাম ব্যবহার করে কেউ ভয় দেখিয়ে টাকা না তুলতে পারে।
একটি সুস্থ ব্যবসায়িক পরিবেশ, বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। দলীয় নামকে অপরাধের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হলে তা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত সবারই দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।