ঢাকা, গুলশান—এক বিভীষিকাময় সন্ধ্যা
২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারিতে একদল সশস্ত্র জঙ্গী হঠাৎ হামলা চালায়। সেদিন ছিল শুক্রবার। রমজানের শেষ ভাগ, ইফতারের পরও অনেকে বসেছিলেন বেকারির ভিতরে। হঠাৎই ছয়-সাত জনের একটি সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, গুলি ছুড়ে পুরো রেস্তোরাঁ দখলে নেয়। আতঙ্কিত অতিথি ও কর্মীদের জিম্মি করে ফেলে তারা। এ হামলায় বিদেশি নাগরিকদের উপস্থিতি আরও শঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।
দখলের পর আতঙ্ক এবং জিম্মি পরিস্থিতি
দখলের পরপরই বেকারির ভিতর থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। আতঙ্কে গুলশান এলাকার মানুষ দোকানপাট বন্ধ করে দেয়, রাস্তায় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। জঙ্গীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামিক স্টেটের মতাদর্শ প্রচার করে বিদেশি জিম্মিদের শিরচ্ছেদ করার হুমকি দিতে থাকে। ভিতরে থাকা বাংলাদেশি এবং বিদেশি নাগরিকদের বাঁচাতে দ্রুতই নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পনা শুরু করে।
র্যাবের অবস্থান গ্রহণ এবং অভিযানের প্রস্তুতি
রাত সাড়ে আটটার মধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। র্যাব সদস্যরা বেকারির চারপাশ ঘিরে ফেলে। তারা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়ক পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রাখে। মিডিয়ার উপস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়। র্যাবের সাথে পুলিশের সোয়াত, বিজিবি এবং সেনা কর্মকর্তাদেরও সমন্বয় গড়ে ওঠে। সারা রাত ধরে এই অবরুদ্ধ অবস্থা চলে। র্যাব স্নাইপার বসায়, মানচিত্র বিশ্লেষণ করে বেকারির ভিতরের কাঠামো বোঝে, এবং সম্ভাব্য অভিযান নিয়ে কৌশল ঠিক করে।
অভিযান শুরুর আগে থমথমে রাত
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সারা দেশের মানুষ টিভি আর অনলাইনে চোখ রাখে। মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করা হয়, তবে পরিস্থিতির বর্ণনা টক শোতে চলতে থাকে। সামাজিক মাধ্যমে গুজব, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে বলেন বিদেশি জিম্মিদের মেরে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রদূতরা নিরাপত্তা চাইতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়মিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। মার্কিন, জাপানি, ইতালিয়ান, ভারতীয় দূতাবাস থেকে জিম্মিদের তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
দেশ-বিদেশে টান টান উত্তেজনা
বাংলাদেশের ভিতরে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক দেখা দেয়। গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় অভিজাত হোটেলগুলো তাদের সিকিউরিটি আরও কঠোর করে। বিদেশি দূতাবাসগুলো নিজেদের কর্মীদের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে। টেলিফোন, ফেসবুক, টুইটারে বাংলাদেশের বাইরে থাকা প্রবাসীরা উদ্বিগ্ন স্বজনদের খোঁজ নেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের এই ঘটনাকে জঙ্গি হামলার বড় প্রমাণ হিসেবে প্রচার করা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন টানা লাইভ কভারেজ করে।
র্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনীর সমন্বিত অভিযান
রাতভর টান টান অবস্থার পর ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনী নেতৃত্বে “থান্ডারবোল্ট” নামে চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়। র্যাব, পুলিশ, সোয়াত যৌথভাবে অংশ নেয়। প্রবল গুলির শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মূল ভবন আক্রমণ করে সেনা কমান্ডোরা। জঙ্গীদের হত্যা করে জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা হয়। তবে ভয়াবহ রক্তপাত হয়। ২০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন যাদের মধ্যে অনেক বিদেশি নাগরিক ছিলেন। অভিযানে দুই পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ হন।
অভিযান-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
অভিযান শেষে র্যাব ও সেনা কর্মকর্তারা জানান, হামলাকারীরা ছিল স্থানীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য, যারা আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকার কঠোর বার্তা দেয় যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। দেশে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশ সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের প্রশংসা করে।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। র্যাবের দ্রুত অবস্থান গ্রহণ, গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার, এবং সেনাবাহিনীর সমন্বিত অভিযানে হামলাটি শেষ হলেও দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহল এই ঘটনার ভয়াবহতা কখনো ভুলতে পারবে না।