বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস জঙ্গি হামলা হলো ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি হামলা। এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তামিম আহমেদ চৌধুরী। আইএস বা ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশ শাখার নেতা হিসেবে তার নিকনেম ছিল “আবু দুজানা আল-বাংলালি”। তার পরিবার, বিদেশে বসবাস, উগ্রপন্থার দিকে ধাবিত হওয়া, হামলার পরিকল্পনা ও তার মৃত্যুর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে বিস্তারিত এই প্রতিবেদন।
পরিবারের শিকড় ও শৈশব
তামিম আহমেদ চৌধুরীর পারিবারিক শিকড় বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলায়। তার পরিবার অভিজাত এবং শিক্ষিত হিসেবে পরিচিত। তার দাদা ছিলেন সিলেটের প্রখ্যাত শিক্ষক। তামিমের বাবা প্রায়শই পরিবারের সঙ্গে কানাডায় যাতায়াত করতেন। তামিমের জন্ম ১৯৮৬ সালে। শৈশবে কিছুদিন বাংলাদেশে কাটালেও পরিবারের সঙ্গে পরে কানাডায় চলে যান। তাদের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ছিল এবং সামাজিক মর্যাদা ছিল উল্লেখযোগ্য।
কানাডায় পড়াশোনা ও উগ্রপন্থার দিকে ঝোঁক
তামিম চৌধুরী কানাডার উইনিপেগে বড় হন। তিনি সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন বলে জানা যায়। কিন্তু পড়াশোনার সময়েই তিনি চরমপন্থী ইসলামী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন। উইনিপেগে অবস্থানকালে কিছু কট্টরপন্থী ইসলামি গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তখন আইএস (ইসলামিক স্টেট) গোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক তাণ্ডব চালাচ্ছিল। সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তামিম আইএস-এর ভাবাদর্শে আকৃষ্ট হন। বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে উন্মাদ হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশে ফিরে আসা ও আইএস শাখা গড়া
কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফেরার পর তামিম আইএস-এর বাংলাদেশ শাখা গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং জেএমবি (জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) থেকে ভেঙে বের হওয়া নতুন জঙ্গি উপদলকে আইএস-এর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি জেএমবির “নিও-জেএমবি” নামে পরিচিত উপদলকে নেতৃত্ব দেন। তামিম খুব সতর্কভাবে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, অনলাইন প্রোপাগান্ডা চালান, এবং তরুণদের ব্রেইনওয়াশ করেন।
হোলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনা
তামিম আহমেদ চৌধুরী হোলি আর্টিজান বেকারি হামলার মূল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত। হামলার আগে তিনি কয়েক মাস ধরে ঢাকায় ও আশেপাশে কয়েকটি স্থানে গোপন বৈঠক করেন। তরুণ হামলাকারীদের আইডিওলজিক্যাল ট্রেনিং দেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাদেশের শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। হামলার আগে তিনি হামলাকারীদের সঙ্গে গুলশান, বসুন্ধরা ও টঙ্গীর আশেপাশে কয়েকটি বাড়িতে বৈঠক করেন।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে পাঁচজন সশস্ত্র জঙ্গি ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও ছিলেন। হামলার দায় আইএস স্বীকার করে, এবং তাদের প্রচারণামূলক ম্যাগাজিনে তামিম আহমেদ চৌধুরীকে “আবু দুজানা আল-বাংলালি” নামে বাংলাদেশে আইএস প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
র্যাবের হাতে মৃত্যু
হামলার পর তামিম আত্মগোপনে চলে যান। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার অবস্থান বদলাতে থাকেন। গোপন সূত্রে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানতে পারে যে তিনি নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে লুকিয়ে আছেন। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট র্যাব ‘হিট-স্ট্রং-২’ নামের একটি অভিযানে ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে।
তামিম আহমেদ চৌধুরী ও তার দুই সহযোগী র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়েই গুলি ছোঁড়ে ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে। র্যাবের সদস্যদের ওপর তারা পাল্টা আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা বন্দুকযুদ্ধ ও বিস্ফোরণের পর র্যাব ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তিনজনকেই মৃত অবস্থায় পায়। অভিযান শেষে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে নিহতদের মধ্যে তামিমই ছিলেন হোলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও আইএসের বাংলাদেশ শাখার শীর্ষ নেতা।
মৃত্যুর আগে তামিমের আচরণ ও শেষ যুদ্ধ
র্যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তামিম আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি এবং তার সঙ্গীরা র্যাবের ওপর গুলি চালিয়ে ও বোমা ছুঁড়ে হত্যার চেষ্টা করেন। তাদের কাছে বেশ কিছু অস্ত্র ও বিস্ফোরকও ছিল। তিনি জীবিত অবস্থায় ধরা পড়লে আইএসের বাংলাদেশের শাখা নিয়ে আরও অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
উপসংহার
তামিম আহমেদ চৌধুরীর জীবনগাথা এক চরমপন্থীর রূপান্তরের গল্প। অভিজাত পারিবারিক পটভূমি, বিদেশে পড়াশোনা করা এক যুবক কীভাবে আইএস মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে দেশে ফিরে এমন রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্ম দিল—তা বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ দমনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুর পর আইএস নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন হলেও উগ্রপন্থার ঝুঁকি এখনও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। তাই তামিমের গল্প বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা।