১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল বাঙালির স্বাধীনতার গৌরবগাথা নয়, এটি এক বেদনার ও কলঙ্কের দলিলও বটে। পাকিস্তান সরকার সেই সময়ে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালির স্বাধীনতা-সংগ্রাম দমাতে সামরিক অভিযান চালায়। সেই অভিযানে স্থানীয় সহযোগী বাহিনী হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি নৃশংস মিলিশিয়া গঠন করে – যার নাম ছিল ‘রাজাকার’। এই বাহিনী বাংলাদেশের মাটি ও জনগণের বিরুদ্ধেই লড়েছিল।
রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টি
১৯৭১ সালের ১ জুন পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাজাকার’ বাহিনী গঠনের ঘোষণা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ধরপাকড় করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে স্থানীয় পর্যায়ে গোয়েন্দা সহায়তা দেওয়া এবং দখলদার বাহিনীর সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের মাধ্যমে এই বাহিনীতে লোক ভর্তির কাজ চালায়।
এই বাহিনীর নাম “রাজাকার” এসেছে উর্দু শব্দ থেকে – যার অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবক’। তবে বাস্তবে এরা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর, স্থানীয় বাঙালি জনগণের শত্রু এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম বাস্তবায়নকারী।
রাজাকারদের মাসিক বেতন-ভাতা
রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তান সরকার নিয়মিত মাসিক বেতন দিত। তাদের পারিশ্রমিক প্রায় ৯০ – ১২০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল, যা তখনকার গ্রামীণ অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে নেহাত কম ছিল না। এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য আলাদা ভাতা, অস্ত্র, পোশাক এবং রেশনও দেওয়া হতো। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় বিত্তশালী পাকিস্তানপন্থীরা রাজাকারদের আর্থিক সহায়তা করত।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা
রাজাকার বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও চলাফেরার খবর জোগাড় করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে দেওয়া। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সন্দেহভাজন মুক্তিযোদ্ধা বা সমর্থকদের ধরিয়ে দিত, তালিকা করত, বাড়িঘর চিনিয়ে দিত। পাকিস্তানি সেনারা অভিযান চালালে রাজাকাররা স্থানীয় ভাষা ও পথঘাট দেখিয়ে দিত। অনেক সময় যৌথ বাহিনী হিসেবে অভিযানে অংশ নিত। তারা আটককৃতদের নির্যাতন করে তথ্য আদায়ের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রাখত।
লুট, ধর্ষণ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ
রাজাকার বাহিনী কেবল সহায়তাই করেনি, নিজেরাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতোই লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।
- বহু গ্রামে রাজাকারদের নেতৃত্বেই ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
- মুক্তিযোদ্ধা বা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি লুট করা হয়।
- অসংখ্য নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে পাঠানো হয়, যেখানে তাদের ধর্ষণ করা হতো।
- নিজেরাও বহু ক্ষেত্রে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা চালাত।
- যেসব পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করত বলে সন্দেহ হতো, তাদের বাড়ি ধ্বংস করা হতো, সম্পদ লুট করা হতো, পুরুষদের ধরে নিয়ে গুলি করা হতো।
রাজাকার বাহিনী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলোর একটি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশে এবং সহযোগিতায় এই বাহিনী বাঙালি জনগণের ওপরে নির্যাতন চালিয়েছে, দেশের মাটিকে রক্তাক্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গেলে রাজাকারদের এই অত্যাচার অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আজও সেই স্মৃতি জাতির বুকে গভীর ক্ষত হয়ে রয়েছে – যা আমাদের সতর্ক করে দেয়, যেন এমন বিশ্বাসঘাতকতা আর কখনো না ঘটে।