সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস এশিয়ার প্রবীণ নেতা ও মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আসিয়ান (ASEAN) জোটে সদস্যপদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয়। ড. মাহাথির স্পষ্ট ভাষায় জানান, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ আসিয়ান সদস্য হওয়ার যোগ্য নয়। তাঁর মতে, যদি আসিয়ান দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশকে নেয়, তবে আসিয়ান ‘এশিয়ার জাতিসংঘ’ হয়ে যাবে।
আসিয়ান কি এবং এর ভৌগোলিক সীমানা
আসিয়ান (Association of Southeast Asian Nations) দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট। এর সদস্য দেশগুলো ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত—যেমন থাইল্যান্ড,ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া,লাওস ও ব্রুনাই। আসিয়ান গঠনের মূল দর্শনই ছিল একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সহযোগিতা।
ড. মাহাথিরের যুক্তি
ড. মাহাথির মোহাম্মাদ শুধু মালয়েশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, দক্ষিণ–পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম রূপকারও। তাঁর অভিজ্ঞতা বিশাল। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ আসিয়ান অঞ্চলের অংশ নয়। যদি আসিয়ান দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশকে নেয়, তবে সীমানা ও চরিত্র বদলে যাবে। তখন এটি এশিয়ার এক ধরনের জাতিসংঘ হয়ে যাবে—যেখানে স্পষ্ট ভৌগোলিক ভিত্তি নষ্ট হবে।
ড. ইউনুসের প্রস্তাব কেন এল
ড. ইউনুস বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নতুন। তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি থাকলেও রাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির অভিজ্ঞতা সীমিত। আসিয়ান সদস্যপদ বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক হতে পারে—এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রস্তাব এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এর আগেও বিভিন্ন আঞ্চলিক ফোরামের দিকে ঝুঁকেছে বাণিজ্য সুবিধা পেতে। তবে আসিয়ান নিয়ে যে স্পষ্ট ভৌগোলিক শর্ত আছে, তা সম্ভবত ইউনুস পর্যাপ্ত বিবেচনা করেননি।
বিশ্লেষণ: কে ঠিক?
ড. মাহাথিরের যুক্তি আন্তর্জাতিক আঞ্চলিক জোটের মূলনীতি অনুযায়ী অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ। আসিয়ান শুধু অর্থনৈতিক ফোরাম নয়, একটি ভৌগোলিক ভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক জোট। বাংলাদেশ সেই ভৌগোলিক অঞ্চলের অংশ নয়। ইউনুসের আকাঙ্ক্ষা দূরদৃষ্টি বা অর্থনৈতিক লাভের ভাবনা থেকে এলেও বাস্তবভিত্তি নেই।
বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত কূটনীতি কী হওয়া উচিত
বাংলাদেশ আসিয়ান অঞ্চলের বাজারে প্রবেশ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে পারে আসিয়ান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা পার্টনারশিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে, যেমন অন্য কিছু দক্ষিণ এশীয় দেশ করেছে। কিন্তু আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ চাওয়া বর্তমান কাঠামোর মধ্যে সম্ভব নয়। অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কদের মতেই বাংলাদেশের উচিত এই সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া এবং বিকল্প পথ খুঁজে নেওয়া।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাব সদিচ্ছা থেকে এলেও অভিজ্ঞতার অভাব স্পষ্ট। ড. মাহাথির মোহাম্মাদের উত্তর কূটনৈতিক এবং বাস্তব—যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক দলকে শিক্ষা হিসেবে নেওয়া উচিত। আঞ্চলিক জোটের সদস্যপদ চাওয়ার আগে তার শর্ত ও কাঠামো বোঝা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেই শর্ত মেনে কৌশল ঠিক করাও প্রয়োজন।