বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মৌসুমী এমন এক নাম, যা শুধুমাত্র একটি প্রজন্ম নয়— অসংখ্য দর্শকের হৃদয়ে দোলা দেয়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলা সিনেমায় তার উত্থান ছিল ঝড়ের মতো, আর পরবর্তী তিন দশকজুড়ে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মৌসুমী এখন বড় পর্দা থেকে অনেকটাই দূরে। কেন এমন হলো? কেমন তার জীবন ও কর্মযাত্রা? সেই গল্পই থাকছে এখানে।
শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
মৌসুমীর জন্ম ১৯৭৩ সালে খুলনায়। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মৌসুমীর ঝোঁক ছিল স্পষ্ট। স্কুলজীবনে গান, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি— সবকিছুতেই পারদর্শিতা দেখাতেন। খুলনার একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই মেয়ের চোখে ছিল বিশাল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নই তাকে টেনে নিয়েছিল ঢাকায়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
বিটিভির মাধ্যমে প্রথম অভিনয়
মৌসুমীর অভিনয় জীবনের প্রথম মঞ্চ ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। খুব অল্প বয়সেই তিনি টিভি নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এই কাজগুলো তার আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে, ভাষা আর প্রকাশের দক্ষতা শানিত করে। টিভির পর্দায় তাকে দেখে দর্শক ও পরিচালকরা বুঝতে পেরেছিলেন— এ মেয়ের মধ্যে আছে বড় তারকা হয়ে ওঠার সব গুণাবলি।
চলচ্চিত্রে আসা: এক স্বপ্নময় যাত্রার শুরু
নব্বই দশকের গোড়ায় বাংলাদেশ টেলিভিশন একটি নতুন মুখের প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। মৌসুমী তাতে অংশ নেন এবং তার সৌন্দর্য, সহজাত অভিনয়শৈলী এবং আত্মবিশ্বাসে সবার নজর কেড়ে নেন। এখান থেকেই তার সিনেমায় অভিনয়ের ডাক আসে।
তার চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ এবং আসল অভিষেক ঘটে ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কালজয়ী ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর মাধ্যমে। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান নতুন মুখ খুঁজছিলেন। প্রতিযোগিতা থেকে নির্বাচিত হয়ে মৌসুমী পেলেন নায়িকার প্রধান চরিত্র। তার বিপরীতে ছিলেন আরেক নতুন মুখ— সালমান শাহ।
রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠা
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির পর মৌসুমীর জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ছবিটি শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মতো তরুণদের মুগ্ধ করে। মৌসুমীর হাসি, চোখের ভাষা, আবেগপ্রবণ সংলাপ আর তার রূপের আবেদন— সবকিছু দর্শকদের হৃদয়জুড়ে স্থায়ী ছাপ ফেলে। সালমান শাহের সঙ্গে গড়ে ওঠা তার রোমান্টিক জুটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা জুটি। এই ছবিই মৌসুমীকে বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির নায়িকায় পরিণত করে।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে মৌসুমী
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর সাফল্যের পর একের পর এক হিট ছবি করেন মৌসুমী। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে আছে— ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ‘দোলা’, ‘লাইলী মজনু’, ‘অন্তরঙ্গ’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। তিনি শুধু বাণিজ্যিক ছবির আড়ম্বরপূর্ণ নায়িকা ছিলেন না— গুণী পরিচালকদের ছবিতেও নিজের অভিনয়ক্ষমতার প্রমাণ দেন। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের ছবিতে তার অভিনয় নতুন মাত্রা যোগ করে।
সালমান শাহের মৃত্যু ও কেরিয়ারে ধাক্কা
১৯৯৬ সালে সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রে এক বড় ধাক্কা এনে দেয়। সালমান-মৌসুমীর জুটি তখন দর্শকদের সবচেয়ে পছন্দের। তার হঠাৎ প্রয়াণে মৌসুমীর কেরিয়ারেও প্রভাব পড়ে। একদিকে ব্যক্তিগত শোক, অন্যদিকে পরিচালক-প্রযোজকেরা নতুন জুটির খোঁজে নেমে পড়েন। মৌসুমী অন্য নায়কদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যান, কিন্তু সালমানের সঙ্গে যে ম্যাজিক তৈরি হতো, তা আর সহজে ফিরে আসেনি।
বৈচিত্র্যময় কাজ ও অবদান
মৌসুমী শুধু নায়িকা হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন। তার পরিচালিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ এবং ‘মি মার্লো’। তিনি বিজ্ঞাপনচিত্র, নাটক, মঞ্চ শো, টেলিভিশন অনুষ্ঠান— সব মাধ্যমেই নিজের উপস্থিতি দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ও রুচির জগতে মৌসুমী ছিলেন একজন ট্রেন্ডসেটার। নায়িকাদের সাজগোজ ও স্টাইলিংয়ে তার প্রভাব স্পষ্ট।
পারিবারিক জীবন: সংসার ও সম্পর্ক
নব্বই দশকের মাঝামাঝি মৌসুমী সহ-অভিনেতা ওমর সানীর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেন। তাদের বাস্তব জীবনের দম্পতি হওয়ার খবর সেই সময় সংবাদমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে। তারা একসঙ্গে অনেক ছবিতেও অভিনয় করেছেন এবং ছিলেন দর্শকদের প্রিয় দম্পতিজুটি।
তাদের সংসারে এক ছেলে (ফারদিন এহসান স্বাধীন) ও এক মেয়ে আছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে তাদের সম্পর্কে দূরত্ব বা বিবাদের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, পরে তারা তা সামলে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
কেন এখন আর সিনেমায় দেখা যায় না?
বর্তমানে মৌসুমী ঢাকাতেই থাকেন। পরিবারের সঙ্গেই রাজধানীতে বসবাস করেন। কিন্তু বড় পর্দায় তাকে খুব একটা দেখা যায় না। এর পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে—
— বয়সজনিত চরিত্র সীমাবদ্ধতা: নায়িকা চরিত্রের প্রস্তাব কমে যাওয়া।
— গল্প ও চরিত্রের অভাব: ভালো মানের স্ক্রিপ্টের সংকট।
— পারিবারিক ব্যস্ততা: পরিবারের জন্য সময় দেওয়া।
— অভিনয় থেকে স্বেচ্ছায় দূরত্ব: দীর্ঘদিনের ক্লান্তি আর ধীরগতির জীবন বেছে নেওয়া।
মৌসুমী অবশ্য মাঝে মাঝে টিভি অনুষ্ঠান, শো বা সাক্ষাৎকারে হাজির হন, নিজের খবর দেন।
মৌসুমীর প্রাপ্ত সম্মাননা ও পুরস্কার
মৌসুমীর অবদান স্বীকৃত হয়েছে বহুবার। তিনি পেয়েছেন—
— জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (মেঘের পরে মেঘ, ২০০৪)।
— বাচসাস পুরস্কার।
— মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার।
— আরও বহু বেসরকারি সম্মাননা ও সম্মানচিহ্ন।
একটি যুগের প্রতীক
মৌসুমী শুধুমাত্র এক নায়িকা নন— তিনি এক যুগের প্রতীক। তার অভিনয়, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। হয়তো আজ তাকে বড় পর্দায় দেখা যায় না, কিন্তু চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে তিনি চিরকাল থেকে যাবেন সেই রোমান্টিক, নরম, গভীর নায়িকা হিসেবে, যিনি এক সময় বাংলাদেশের রূপালী পর্দা দাপটের সাথে শাসন করেছেন।