০২:০৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

ইউটিউব থেকে অর্থ আয়ের নীতিতে পরিবর্তন, কনটেন্ট নির্মাতাদের উপর কী প্রভাব পড়বে?

ইউটিউবের মানিটাইজেশন বিষয়ক নীতির নতুন আপডেট করা হয়েছে- প্রতীকী ছবি।

অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব তার ‘মানিটাইজেশন’ বা ভিডিও থেকে নির্মাতাদের অর্থ আয়ের নীতিতে নতুন আপডেট এনেছে।

এর ফলে অন্যদের কনটেন্ট বা আগে ব্যবহার করা ভিডিও পুনরায় ইউটিউবে ছেড়ে আর অর্থ আয় করা যাবে না। ইউটিউব থেকে অর্থ আয় করতে হলে অবশ্যই কনটেন্ট বা ভিডিওতে নতুন অথবা কিছুটা মৌলিকত্ব থাকতে হবে।

‘অরিজিনাল কন্টেন্ট’ অর্থাৎ মৌলিকত্ব রয়েছে এমন কন্টেন্টকে উৎসাহ দিতে এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে ইউটিউব।

নীতিমালা আপগ্রেড করার বিষয়ে ঘোষণার পর থেকেই যারা কন্টেন্ট তৈরি করেন তাদের মধ্যে মধ্যে এই নিয়ে ‘আগ্রহ’ এবং ‘উদ্বেগ’ দুই-ই ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকের উদ্বেগের কারণ, কোনো সৃজনশীলতা যোগ না করেই রেডিমেড (ইতিমধ্যে বিদ্যমান কন্টেন্ট যা অন্য কেউ তৈরি করেছেন) কন্টেন্ট ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করে, এমন বিপুল সংখ্যক চ্যানেল রয়েছে।

আর আগ্রহের একটা বড় কারণ হলো ইউটিউব বহুদিন ধরেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল যে, অরিজিনাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা পদক্ষেপ নেবে।

ওই নীতিমালা কার্যকর হয়েছে মঙ্গলবার (১৫ই জুলাই) থেকে।

১৫ই জুলাই থেকে এই নীতি কার্যকর হচ্ছে- প্রতীকী ছবি।

ইউটিউব যা জানিয়েছে

ইউটিউব বলছে, “আমরা আমাদের রিপিটিশাস কন্টেন্ট (পুনরাবৃত্তিমূলক কন্টেন্ট) বিষয়ক নীতিতে একটা ছোটখাটো আপডেট করছি যাতে রিপিটিশাস কন্টেন্ট বা মাস প্রোডিউসড কন্টেন্টকে শনাক্ত করা যায়।”

“আমরা এই নীতির নাম রিপিটিশাস কন্টেন্ট থেকে পরিবর্তন করে ইনঅথেন্টিকেটেড কন্টেন্ট রাখছি। বিদ্যমান নীতির আওতায় যেখানে স্রষ্টাদের তাদের সৃজনশীলতা এবং অরিজিনাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য পুরস্কৃত করা হয়, সেখানে ওই জাতীয় কন্টেন্ট মানিটাইজেশনের জন্য অযোগ্য।”

পাশাপাশি জানানো হয়েছে ‘রিইউজড কন্টেন্ট’ অর্থাৎ রেডিমেড কোনো কন্টেন্টে কিছু নতুন যোগ করে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই।

ইউটিউব জানিয়েছে, “আমাদের রিইউজড কন্টেন্ট যেখানে কমেন্ট্রি (ধারাভাষ্য বা মন্তব্য যোগ করা) , ক্লিপ, কম্পাইলেশন (কন্টেন্টের সংকলন) এবং ভিডিও রিক্রিয়েশন করা হয়, সেই সংক্রান্ত নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।”

ইউটিউবের ‘এডিটোরিয়াল অ্যান্ড ক্রিয়েটর লিয়াজোঁ’ রেনে রিচি এক ভিডিওতে বলেছেন, “এটা একটা ছোটখাটো আপডেট। আমাদের উদ্দেশ্য ইন অথেন্টিকেটেড কন্টেন্টকে আরো ভালভাবে শনাক্ত করা। এটা কোনোভাবে রিক্রিয়েট করা ভিডিও বা ক্লিপের সংকলনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নয়।”

“একই ভিডিও যা ঘুরে ফিরে বারবার আসছে বা মাসপ্রোডিউস হচ্ছে, যেটা মানুষের কাছে স্প্যামের মতো, সেটাকে অর্থায়নের অযোগ্য বলে মনে মনে করা হচ্ছে- এই যা।”

মৌলিক কন্টেন্টকে উৎসাহ দিতে এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে ইউটিউব- প্রতীকী ছবি।

এর অর্থ কী

সহজভাবে বলতে গেলে এবার থেকে ক্রিয়েটর মাথায় রাখতে হবে তারা যে কন্টেন্ট তৈরি করছেন সেখানে যেন মৌলিকত্ব বা নতুন কিছু থাকে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সৌম্যক সেনগুপ্ত বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “রিপিটিশাস কনটেন্টকে ইনঅথেন্টিক কনটেন্ট হিসাবে পুনর্বিবেচনা করার এই পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। এটা কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে মৌলিকত্ব আনার বিষয়কে উৎসাহ দেয় এবং এই নিয়ে ইউটিউব বহুদিন ধরেই প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসছিল।”

‘রিপিটিশাস কন্টেন্ট’ এবং ‘রিইউজড কন্টেন্ট’ কোনগুলো তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।

তার কথায়, “অন্যের বানানো কোনো কন্টেন্টে নতুন কিছু যোগ না করে ব্যবহার করলে তা রিপিটিশাস কন্টেন্টের আওতায় পড়ে। আবার ইতিমধ্যে তৈরি করা কোনো কন্টেন্টে ব্যাখ্যা, অডিও ইত্যাদি যোগ করে যদি তা দর্শকদের কাছে তুলে ধরা হয়, তাহলে তা রিউজড কন্টেন্ট।”

আর ‘মাসপ্রোডিউসড কনটেন্টের’ ক্ষেত্রে ‘টেমপ্লেট’ ইত্যাদির বদল না করে ব্যাপক হারে কন্টেন্ট তৈরি করা হয়। সেখানে নতুন কিছু যোগ করা হয় না।

মি. সেন বলেছেন, “আপডেট করা নীতিমালায় রিপিটিশাস বা মাসপ্রোডিউসড কন্টেন্টকে অর্থায়নের অযোগ্য বলে জানানো হলেও রিউজড কনটেন্টের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। আসলে ইউটিউব চাইছে ভিডিওতে মৌলিকত্ব আসুক নিদেনপক্ষে নতুন কিছু যোগ করা হোক।” এতে প্ল্যাটফর্মের মানও বাড়ে।

এই বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো ভিডিওর মাসপ্রোডাকশন বা গণহারে তৈরি করা কঠিন কাজ নয়।

মি. সেনের কথায়, “এখন এআই প্রম্পট ব্যবহার করে ব্যাপক হারে কন্টেন্ট তৈরির কাজ সহজ। আজকের দিনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কোনটা খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে তার উপর কন্টেন্ট তৈরি সবই অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে সহজেই হয়ে যায়। এইভাবে বিনা পরিশ্রম করেই মাসপ্রোডাকশন করে অর্থলাভ করা যেত। এটা বন্ধ করতে চাইছে ইউটিউব।”

গত কয়েক বছরে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা-প্রতীকী ছবি।

সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভিডিওর বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারেই দেখে এসেছে এই সংস্থা।

কোন কন্টেন্ট এআই ব্যবহার করে তৈরি, তা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হয়েছে ইউটিউব, যাতে তারা ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পারে। আর এখন কন্টেন্টে মৌলিকতার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

ইউটিউব বলেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি, ভিডিও ইত্যাদির বিষয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে। যদিও কোনভাবে কন্টেন্টের মান বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে কোনও সমস্যা নেই বলে জানানো হয়েছে। মোটের উপর এআয়ের ‘অপব্যবহার’ রুখতে উদ্যোগী এই সংস্থা।

এই নীতিমালার আপডেটের কথা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন।

“আসলে একটা বড় সংখ্যক চ্যানেল রেডিমেড ভিডিওকে নিজেদের কন্টেন্ট হিসাবে ব্যবহার করে আয় করত। এতে যারা সৃজনশীল এবং মৌলিক কাজ করেন তাদের সমস্যায় পড়তে হতো। একটা হিট কন্টেন্টকে আবার ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ ভিউ পেয়েছে এমন বহু চ্যানেল আছে,” বলেছেন সিমরন কৌর। তার গবেষণার বিষয় সামাজিক গণমাধ্যম এবং ইনফ্লুয়েন্সার।

তিনি বলেছেন, “মোবাইল এবং ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি থাকায় এখন যে কেউ কন্টেন্ট তৈরি করতে পারেন। গত কয়েক বছরে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষত কোভিডের সময় লকডাউনের সময় থেকে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে আয়ও করা শুরু করেছেন। বিশ্বজুড়ে তো বটেই, ভারতেও অনেকের কাছে এটা ফুলটাইম পেশা।”

“শুধুমাত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী, শেফ বা সেলেব্রিটিদেরই নয় একজন গৃহবধূ থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি- যে কেউ জনপ্রিয় ক্রিয়েটর হতে পারেন। তাদের কারো কারো ফলোয়ার বা সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা নামজাদা অভিনেতাদের টেক্কা দেওয়ার মতো। তবে, একদিকে যেমন অসংখ্য সৃষ্টিশীল ক্রিয়েটর রয়েছেন তেমনই, সৃজনশীলতার অভাব আছে, এমন ক্রিয়েটররের সংখ্যাও কম নয়।”

তার মতে, “তাছাড়া ফলোয়ার ধরে রাখতে গেলে নিয়মিত কন্টেন্ট আপলোড করতে হয়, তাই অনেকেই এই মাসপ্রোডাকশান এবং রিপিটিশাস ভিডিওর উপর নির্ভর করেন। তাদের অনেকে উদ্বিগ্ন যে ইউটিউবের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে তাদের সেই আয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

তবে ইউটিউবের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক বলেই মনে করছে তার মতো বিশেষজ্ঞরা।

মি. সেন বলেছেন, “ইউটিউবের এই পদক্ষেপকে যারা অনুকরণের বদলে মৌলিক কাজ করেন, সেই সমস্ত ক্রিয়েটরদের পুরস্কৃত করার একটা অপরিহার্য পদক্ষেপ বলেই মনে করি।”

“এটা তো শুধুমাত্র অ্যালগোরিদম-এর আউটপুট নয়। এখানে স্রষ্টার সৃজনশীলতা, আবেগ, অন্তর্দৃষ্টি এবং পরিশ্রম রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো সাহায্য করতে পারে কিন্তু স্রষ্টাকে তার স্বীকৃতি দিতে হবে।”

শেফ ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর মীত প্যাটেল।

‘মৌলিকত্বে বিশ্বাসীদের জন্য বড় সুযোগ’

ইউটিউবাররা বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

শেফ এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটর মীত প্যাটেল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন , “কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে আট বছরের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আমার মনে হয় ইউটিউবের এই নয়া আপডেট বিশ্বজুড়ে স্রষ্টাদের উপর প্রভাব ফেলবে। যারা শুধুমাত্র রেডিমেড কন্টেন্ট, এআই-এর মাধ্যমে তৈরি কন্টেন্ট, কপি করা ভিডিও ব্যবহার করেন অথবা খুব কম পরিশ্রমে তৈরি কন্টেন্ট পরিবেশন করেন, তাদের আয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।”

“অন্যদিকে, আমার মতো অনেকেই যারা শুরু থেকে একেবারে নিজস্ব কন্টেন্ট তৈরি করছেন, তাদের ক্ষতি হবে না। বরং যারা মৌলিক কন্টেন্ট তৈরি করেন, তাদের আয় কিছুটা বাড়িয়ে দেবে এই নতুন আপডেট।”

গুজরাতের বাসিন্দা মি. প্যাটেলের ইউটিউব এবং ফেসবুকে ফুড চ্যানেলে অনুরাগীদের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।

মি. প্যাটেল বলেছেন, “এতদিন স্টক ভিডিও পুনঃব্যবহার, ট্রেন্ডিং বিষয়, বা স্বয়ংক্রিয় স্লাইডশোর মতো জিনিস ব্যবহার করে কন্টেন্ট তৈরি তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। প্রকৃত সৃজনশীলতা বা মৌলিকত্ব যোগ না করেই অর্থায়নযোগ্য ছিল সেই কন্টেন্ট।”

“কিন্তু এখন কন্টেন্ট রূপান্তর করতে হবে, মন্তব্য যোগ করতে হবে, নিজস্বতা আনতে হবে। বাস্তবে নতুন কিছু না কিছু অবদান রাখতেই হবে। রিপোস্ট বা সামান্য এডিট করে পোস্ট করা চলবে না।”

“আমার অভিজ্ঞতা বলছে মানুষ কিন্তু মৌলিক কন্টেন্ট এবং সেটা তৈরির সৎচেষ্টার সঙ্গে নিজেদের অনায়াসে জুড়তে পারেন। বিষয়টা এখন আর কন্টেন্ট তৈরি বা অনুকরণেই সীমাবদ্ধ নেই। এখানে নিজস্ব স্টাইল, মানুষকে নতুন কিছু দেওয়া, তাদের হাসানো, তাদের আবেগকে ছুঁয়ে যাওয়া, মনোরঞ্জন সবকিছু জড়িয়ে রয়েছে। তা সেটা নতুন রেসিপি শেয়ার করার মাধ্যমে হোক বা ট্রেন্ড অনুসরণ করে তৈরি কন্টেটের হাত ধরে।”

কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নিরঞ্জন মণ্ডল।

“যারা অনুকরণ করতেন, তাদের কাছেও এটা সুযোগ”

কলকাতার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নিরঞ্জন মণ্ডল একজন পরিচিত মুখ। তার তৈরি হাস্যরসাত্মক কন্টেন্ট এই তরুণকে অনেকের কাছে পরিচিত মুখ করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অনুরাগীদের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।

এই ইউটিউবার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের কথায়, “এটা অরিজিনাল কন্টেন্ট এবং তাদের স্রষ্টা দুজনকে রক্ষা করার জন্য একটা ভালো উদ্যোগ। যারা নিজেদের মৌলিকত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষের মনোরঞ্জন করেন, তাদের জন্য এটা (ইউটিউবের নয়া আপডেট) জাস্টিস।”

তিনি বলছেন, “যারা ওই জাতীয় (পুনরাবৃত্তিমূলক) কন্টেন্ট ব্যবহার করেন, তাদের জন্যও এটা একদিক থেকে ভাল। কারণ আয় হবে না বলে তারা অনুকরণের বদলে নিজেদের কন্টেন্ট তৈরির বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। নতুন কিছু করার চেষ্টা করবেন।”

বিবিসি নিউজ বাংলা

ইউটিউব থেকে অর্থ আয়ের নীতিতে পরিবর্তন, কনটেন্ট নির্মাতাদের উপর কী প্রভাব পড়বে?

০৩:১২:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব তার ‘মানিটাইজেশন’ বা ভিডিও থেকে নির্মাতাদের অর্থ আয়ের নীতিতে নতুন আপডেট এনেছে।

এর ফলে অন্যদের কনটেন্ট বা আগে ব্যবহার করা ভিডিও পুনরায় ইউটিউবে ছেড়ে আর অর্থ আয় করা যাবে না। ইউটিউব থেকে অর্থ আয় করতে হলে অবশ্যই কনটেন্ট বা ভিডিওতে নতুন অথবা কিছুটা মৌলিকত্ব থাকতে হবে।

‘অরিজিনাল কন্টেন্ট’ অর্থাৎ মৌলিকত্ব রয়েছে এমন কন্টেন্টকে উৎসাহ দিতে এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে ইউটিউব।

নীতিমালা আপগ্রেড করার বিষয়ে ঘোষণার পর থেকেই যারা কন্টেন্ট তৈরি করেন তাদের মধ্যে মধ্যে এই নিয়ে ‘আগ্রহ’ এবং ‘উদ্বেগ’ দুই-ই ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকের উদ্বেগের কারণ, কোনো সৃজনশীলতা যোগ না করেই রেডিমেড (ইতিমধ্যে বিদ্যমান কন্টেন্ট যা অন্য কেউ তৈরি করেছেন) কন্টেন্ট ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করে, এমন বিপুল সংখ্যক চ্যানেল রয়েছে।

আর আগ্রহের একটা বড় কারণ হলো ইউটিউব বহুদিন ধরেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল যে, অরিজিনাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা পদক্ষেপ নেবে।

ওই নীতিমালা কার্যকর হয়েছে মঙ্গলবার (১৫ই জুলাই) থেকে।

১৫ই জুলাই থেকে এই নীতি কার্যকর হচ্ছে- প্রতীকী ছবি।

ইউটিউব যা জানিয়েছে

ইউটিউব বলছে, “আমরা আমাদের রিপিটিশাস কন্টেন্ট (পুনরাবৃত্তিমূলক কন্টেন্ট) বিষয়ক নীতিতে একটা ছোটখাটো আপডেট করছি যাতে রিপিটিশাস কন্টেন্ট বা মাস প্রোডিউসড কন্টেন্টকে শনাক্ত করা যায়।”

“আমরা এই নীতির নাম রিপিটিশাস কন্টেন্ট থেকে পরিবর্তন করে ইনঅথেন্টিকেটেড কন্টেন্ট রাখছি। বিদ্যমান নীতির আওতায় যেখানে স্রষ্টাদের তাদের সৃজনশীলতা এবং অরিজিনাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য পুরস্কৃত করা হয়, সেখানে ওই জাতীয় কন্টেন্ট মানিটাইজেশনের জন্য অযোগ্য।”

পাশাপাশি জানানো হয়েছে ‘রিইউজড কন্টেন্ট’ অর্থাৎ রেডিমেড কোনো কন্টেন্টে কিছু নতুন যোগ করে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই।

ইউটিউব জানিয়েছে, “আমাদের রিইউজড কন্টেন্ট যেখানে কমেন্ট্রি (ধারাভাষ্য বা মন্তব্য যোগ করা) , ক্লিপ, কম্পাইলেশন (কন্টেন্টের সংকলন) এবং ভিডিও রিক্রিয়েশন করা হয়, সেই সংক্রান্ত নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।”

ইউটিউবের ‘এডিটোরিয়াল অ্যান্ড ক্রিয়েটর লিয়াজোঁ’ রেনে রিচি এক ভিডিওতে বলেছেন, “এটা একটা ছোটখাটো আপডেট। আমাদের উদ্দেশ্য ইন অথেন্টিকেটেড কন্টেন্টকে আরো ভালভাবে শনাক্ত করা। এটা কোনোভাবে রিক্রিয়েট করা ভিডিও বা ক্লিপের সংকলনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নয়।”

“একই ভিডিও যা ঘুরে ফিরে বারবার আসছে বা মাসপ্রোডিউস হচ্ছে, যেটা মানুষের কাছে স্প্যামের মতো, সেটাকে অর্থায়নের অযোগ্য বলে মনে মনে করা হচ্ছে- এই যা।”

মৌলিক কন্টেন্টকে উৎসাহ দিতে এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে ইউটিউব- প্রতীকী ছবি।

এর অর্থ কী

সহজভাবে বলতে গেলে এবার থেকে ক্রিয়েটর মাথায় রাখতে হবে তারা যে কন্টেন্ট তৈরি করছেন সেখানে যেন মৌলিকত্ব বা নতুন কিছু থাকে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সৌম্যক সেনগুপ্ত বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “রিপিটিশাস কনটেন্টকে ইনঅথেন্টিক কনটেন্ট হিসাবে পুনর্বিবেচনা করার এই পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। এটা কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে মৌলিকত্ব আনার বিষয়কে উৎসাহ দেয় এবং এই নিয়ে ইউটিউব বহুদিন ধরেই প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসছিল।”

‘রিপিটিশাস কন্টেন্ট’ এবং ‘রিইউজড কন্টেন্ট’ কোনগুলো তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।

তার কথায়, “অন্যের বানানো কোনো কন্টেন্টে নতুন কিছু যোগ না করে ব্যবহার করলে তা রিপিটিশাস কন্টেন্টের আওতায় পড়ে। আবার ইতিমধ্যে তৈরি করা কোনো কন্টেন্টে ব্যাখ্যা, অডিও ইত্যাদি যোগ করে যদি তা দর্শকদের কাছে তুলে ধরা হয়, তাহলে তা রিউজড কন্টেন্ট।”

আর ‘মাসপ্রোডিউসড কনটেন্টের’ ক্ষেত্রে ‘টেমপ্লেট’ ইত্যাদির বদল না করে ব্যাপক হারে কন্টেন্ট তৈরি করা হয়। সেখানে নতুন কিছু যোগ করা হয় না।

মি. সেন বলেছেন, “আপডেট করা নীতিমালায় রিপিটিশাস বা মাসপ্রোডিউসড কন্টেন্টকে অর্থায়নের অযোগ্য বলে জানানো হলেও রিউজড কনটেন্টের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। আসলে ইউটিউব চাইছে ভিডিওতে মৌলিকত্ব আসুক নিদেনপক্ষে নতুন কিছু যোগ করা হোক।” এতে প্ল্যাটফর্মের মানও বাড়ে।

এই বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো ভিডিওর মাসপ্রোডাকশন বা গণহারে তৈরি করা কঠিন কাজ নয়।

মি. সেনের কথায়, “এখন এআই প্রম্পট ব্যবহার করে ব্যাপক হারে কন্টেন্ট তৈরির কাজ সহজ। আজকের দিনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কোনটা খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে তার উপর কন্টেন্ট তৈরি সবই অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে সহজেই হয়ে যায়। এইভাবে বিনা পরিশ্রম করেই মাসপ্রোডাকশন করে অর্থলাভ করা যেত। এটা বন্ধ করতে চাইছে ইউটিউব।”

গত কয়েক বছরে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা-প্রতীকী ছবি।

সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভিডিওর বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারেই দেখে এসেছে এই সংস্থা।

কোন কন্টেন্ট এআই ব্যবহার করে তৈরি, তা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হয়েছে ইউটিউব, যাতে তারা ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পারে। আর এখন কন্টেন্টে মৌলিকতার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

ইউটিউব বলেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি, ভিডিও ইত্যাদির বিষয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে। যদিও কোনভাবে কন্টেন্টের মান বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে কোনও সমস্যা নেই বলে জানানো হয়েছে। মোটের উপর এআয়ের ‘অপব্যবহার’ রুখতে উদ্যোগী এই সংস্থা।

এই নীতিমালার আপডেটের কথা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন।

“আসলে একটা বড় সংখ্যক চ্যানেল রেডিমেড ভিডিওকে নিজেদের কন্টেন্ট হিসাবে ব্যবহার করে আয় করত। এতে যারা সৃজনশীল এবং মৌলিক কাজ করেন তাদের সমস্যায় পড়তে হতো। একটা হিট কন্টেন্টকে আবার ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ ভিউ পেয়েছে এমন বহু চ্যানেল আছে,” বলেছেন সিমরন কৌর। তার গবেষণার বিষয় সামাজিক গণমাধ্যম এবং ইনফ্লুয়েন্সার।

তিনি বলেছেন, “মোবাইল এবং ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি থাকায় এখন যে কেউ কন্টেন্ট তৈরি করতে পারেন। গত কয়েক বছরে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষত কোভিডের সময় লকডাউনের সময় থেকে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে আয়ও করা শুরু করেছেন। বিশ্বজুড়ে তো বটেই, ভারতেও অনেকের কাছে এটা ফুলটাইম পেশা।”

“শুধুমাত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী, শেফ বা সেলেব্রিটিদেরই নয় একজন গৃহবধূ থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি- যে কেউ জনপ্রিয় ক্রিয়েটর হতে পারেন। তাদের কারো কারো ফলোয়ার বা সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা নামজাদা অভিনেতাদের টেক্কা দেওয়ার মতো। তবে, একদিকে যেমন অসংখ্য সৃষ্টিশীল ক্রিয়েটর রয়েছেন তেমনই, সৃজনশীলতার অভাব আছে, এমন ক্রিয়েটররের সংখ্যাও কম নয়।”

তার মতে, “তাছাড়া ফলোয়ার ধরে রাখতে গেলে নিয়মিত কন্টেন্ট আপলোড করতে হয়, তাই অনেকেই এই মাসপ্রোডাকশান এবং রিপিটিশাস ভিডিওর উপর নির্ভর করেন। তাদের অনেকে উদ্বিগ্ন যে ইউটিউবের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে তাদের সেই আয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

তবে ইউটিউবের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক বলেই মনে করছে তার মতো বিশেষজ্ঞরা।

মি. সেন বলেছেন, “ইউটিউবের এই পদক্ষেপকে যারা অনুকরণের বদলে মৌলিক কাজ করেন, সেই সমস্ত ক্রিয়েটরদের পুরস্কৃত করার একটা অপরিহার্য পদক্ষেপ বলেই মনে করি।”

“এটা তো শুধুমাত্র অ্যালগোরিদম-এর আউটপুট নয়। এখানে স্রষ্টার সৃজনশীলতা, আবেগ, অন্তর্দৃষ্টি এবং পরিশ্রম রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো সাহায্য করতে পারে কিন্তু স্রষ্টাকে তার স্বীকৃতি দিতে হবে।”

শেফ ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর মীত প্যাটেল।

‘মৌলিকত্বে বিশ্বাসীদের জন্য বড় সুযোগ’

ইউটিউবাররা বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

শেফ এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটর মীত প্যাটেল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন , “কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে আট বছরের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আমার মনে হয় ইউটিউবের এই নয়া আপডেট বিশ্বজুড়ে স্রষ্টাদের উপর প্রভাব ফেলবে। যারা শুধুমাত্র রেডিমেড কন্টেন্ট, এআই-এর মাধ্যমে তৈরি কন্টেন্ট, কপি করা ভিডিও ব্যবহার করেন অথবা খুব কম পরিশ্রমে তৈরি কন্টেন্ট পরিবেশন করেন, তাদের আয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।”

“অন্যদিকে, আমার মতো অনেকেই যারা শুরু থেকে একেবারে নিজস্ব কন্টেন্ট তৈরি করছেন, তাদের ক্ষতি হবে না। বরং যারা মৌলিক কন্টেন্ট তৈরি করেন, তাদের আয় কিছুটা বাড়িয়ে দেবে এই নতুন আপডেট।”

গুজরাতের বাসিন্দা মি. প্যাটেলের ইউটিউব এবং ফেসবুকে ফুড চ্যানেলে অনুরাগীদের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।

মি. প্যাটেল বলেছেন, “এতদিন স্টক ভিডিও পুনঃব্যবহার, ট্রেন্ডিং বিষয়, বা স্বয়ংক্রিয় স্লাইডশোর মতো জিনিস ব্যবহার করে কন্টেন্ট তৈরি তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। প্রকৃত সৃজনশীলতা বা মৌলিকত্ব যোগ না করেই অর্থায়নযোগ্য ছিল সেই কন্টেন্ট।”

“কিন্তু এখন কন্টেন্ট রূপান্তর করতে হবে, মন্তব্য যোগ করতে হবে, নিজস্বতা আনতে হবে। বাস্তবে নতুন কিছু না কিছু অবদান রাখতেই হবে। রিপোস্ট বা সামান্য এডিট করে পোস্ট করা চলবে না।”

“আমার অভিজ্ঞতা বলছে মানুষ কিন্তু মৌলিক কন্টেন্ট এবং সেটা তৈরির সৎচেষ্টার সঙ্গে নিজেদের অনায়াসে জুড়তে পারেন। বিষয়টা এখন আর কন্টেন্ট তৈরি বা অনুকরণেই সীমাবদ্ধ নেই। এখানে নিজস্ব স্টাইল, মানুষকে নতুন কিছু দেওয়া, তাদের হাসানো, তাদের আবেগকে ছুঁয়ে যাওয়া, মনোরঞ্জন সবকিছু জড়িয়ে রয়েছে। তা সেটা নতুন রেসিপি শেয়ার করার মাধ্যমে হোক বা ট্রেন্ড অনুসরণ করে তৈরি কন্টেটের হাত ধরে।”

কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নিরঞ্জন মণ্ডল।

“যারা অনুকরণ করতেন, তাদের কাছেও এটা সুযোগ”

কলকাতার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নিরঞ্জন মণ্ডল একজন পরিচিত মুখ। তার তৈরি হাস্যরসাত্মক কন্টেন্ট এই তরুণকে অনেকের কাছে পরিচিত মুখ করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অনুরাগীদের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।

এই ইউটিউবার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের কথায়, “এটা অরিজিনাল কন্টেন্ট এবং তাদের স্রষ্টা দুজনকে রক্ষা করার জন্য একটা ভালো উদ্যোগ। যারা নিজেদের মৌলিকত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষের মনোরঞ্জন করেন, তাদের জন্য এটা (ইউটিউবের নয়া আপডেট) জাস্টিস।”

তিনি বলছেন, “যারা ওই জাতীয় (পুনরাবৃত্তিমূলক) কন্টেন্ট ব্যবহার করেন, তাদের জন্যও এটা একদিক থেকে ভাল। কারণ আয় হবে না বলে তারা অনুকরণের বদলে নিজেদের কন্টেন্ট তৈরির বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। নতুন কিছু করার চেষ্টা করবেন।”

বিবিসি নিউজ বাংলা