বর্তমান পরিস্থিতি: শুল্ক বেড়েছে, উদ্বেগও বেড়েছে
বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন সংকটময় অবস্থায়। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা গার্মেন্টস‑পণ্যে প্রচলিত ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে নতুন করে ৩৫ শতাংশ আরোপ হওয়ায় মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে—খাতটির জন্য একেবারে চরম ধাক্কা। ব্যবসায়ীদের মতে, এ পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে, আমেরিকার সঙ্গে সরকারের আলোচনা মূলত শেষ পর্যায়ে নতুন করে আলোচনার সম্ভাবনা কম, সরকার এখনও নতুন করে আলোচনার কোন সময়সূচী আমেরিকার কাছ থেকে পায়নি। যার ফলে ১ আগষ্ট থেকে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের আগের ১৫% এবং নতুন আরোপিত ৩৫% মোট ৫০ % শুল্ক দিতে হবে রফতানি পন্যর ওপর। এছাড়া গার্মেন্টস মালিকরা জানিয়েছে তাদের ক্রেতারা ইতোমধ্যে তাদেরকে জানাচ্ছে নতুন অর্ডারে এই ৫০ ভাগ শুল্ক বাংলাদেশী মালিকদের বহন করতে হবে।
পরিকল্পনা: স্থানান্তরের ভাবনা এখন বাস্তব আলোচনায়
এ চাপের মুখে অনেক উদ্যোক্তা দেশ থেকে কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সাক্ষাৎ পরিকল্পনা করছেন। তাঁদের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে এত উচ্চ শুল্ক দিতে হলে এমন দেশে উৎপাদন গড়ে তোলা ভালো, যেখানে কম শুল্কে মার্কিন বাজারে পণ্য পাঠানো যাবে।
ধাপে ধাপে সম্ভাব্য স্থানান্তরের বিশ্লেষণ
প্রথম ধাপ: বিদ্যমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন
উদ্যোক্তারা আগে মার্কিন বাজারে পণ্যের প্রবেশ‑ব্যয়, শুল্কহার ও ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডগুলো জানিয়েছে—এই শুল্কের দায়ভার তারা নেবে না; তাই সম্পূর্ণ চাপ উৎপাদনকারীদের কাঁধে পড়েছে।
দ্বিতীয় ধাপ: বিকল্প দেশের অনুসন্ধান
শুল্কের ধাক্কা এড়াতে উদ্যোক্তারা এখন খুঁজছেন কোন কোন দেশে কারখানা সরিয়ে নেওয়া যায়। বিবেচনায় আসছে—
• যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক‑সমঝোতা থাকা দেশ
• রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
• শ্রম‑খরচ ও উৎপাদন‑ব্যয়
• উন্নত অবকাঠামো ও নীতিগত সহায়তা
তৃতীয় ধাপ: সম্ভাব্য গন্তব্য বিশ্লেষণ
ক) ভিয়েতনাম
ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০ শতাংশ শুল্ক‑চুক্তি করেছে, যা বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। দক্ষ শ্রমশক্তি, আধুনিক অবকাঠামো ও রপ্তানি‑বান্ধব নীতিমালায় দেশটি এগিয়ে। চ্যালেঞ্জ—জমির স্বল্পতা ও কিছু খাতে তুলনামূলক বেশি উৎপাদন‑ব্যয়।
খ) ভারত
ভারত‑যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় গার্মেন্টস পণ্যে শুল্ক ১৭–১৮ শতাংশে নামার সম্ভাবনা। বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার, উন্নত অবকাঠামো ও গার্মেন্টস‑ক্লাস্টার সুবিধা ভারতের আকর্ষণ বাড়ায়। পশ্চিমবঙ্গ বা অন্ধ্রপ্রদেশের মতো অঞ্চলে বাংলা‑ভাষী শ্রমিক পাওয়া সহজ হতে পারে।
গ) ইথিওপিয়া ও পূর্ব আফ্রিকা
ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়া আফ্রিকান গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্ট (AGOA)‑এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। শ্রম‑খরচ কম, তবে দুর্বল অবকাঠামো ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বড় বাধা।
ঘ) কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া
এই দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য‑সমঝোতার মধ্যে রয়েছে এবং তুলনামূলক সস্তায় উৎপাদন সম্ভব। তবে স্থানীয় শ্রম‑আইন এবং সংস্কৃতিগত দূরত্ব কিছুটা জটিলতা তৈরি করতে পারে।
চতুর্থ ধাপ: নীতিনির্ধারণ ও স্থান‑নির্বাচন
সবচেয়ে সম্ভাব্য গন্তব্য সে‑সব দেশ, যেখানে—
• যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির শুল্ক কম
• দক্ষ শ্রমশক্তি সহজে মেলে
• বিদ্যুৎ, পরিবহন ও আইটি‑ব্যবস্থা উন্নত
• রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল
এই মানদণ্ডে ভারত ও ভিয়েতনামই এখন সবচেয়ে এগিয়ে। ভাষাগত‑সাংস্কৃতিক দিক থেকেও ভারত কিছুটা বাড়তি সুবিধা দিতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ বার্তা
একটি সতর্কবার্তা
গার্মেন্টস শিল্প স্থানান্তরের ভাবনা নিছক ব্যবসায়িক কৌশল নয়; এটি জাতীয় অর্থনীতির বড় বিপদের ইঙ্গিত। কারণ দেশের রপ্তানি‑আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এই খাতনির্ভর। শিল্প সরতে শুরু করলে পুরো অর্থনীতি সুবিস্তৃত ঝুঁকিতে পড়বে।
সরকারের দায়িত্ব
অবস্থা সঙ্গিন হওয়ার আগেই সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জরুরি আলোচনায় বসে যৌক্তিক সমঝোতায় পৌঁছানো। নইলে, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটি দেশের মাটিতে তৈরি না‑ও থাকতে পারে।
এখনও সময় আছে, তবে জানালাটি দ্রুত বন্ধ হচ্ছে
গার্মেন্টস খাত এখন মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে। দ্রুত কূটনৈতিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত না নিলে শিগগিরই এই শিল্প অন্য দেশের মাটিতে গড়ে উঠবে, আর দেশের শ্রমিকরা হারাবে আয়ের প্রধান উৎস। বাস্তবতা বুঝে এখনই সক্রিয় হওয়ার সময়।