মসলার বাজারে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের রান্না ও খাদ্যসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মসলা। দেশীয় উৎপাদন কিছুটা চাহিদা পূরণ করলেও তা মোটেও যথেষ্ট নয়। ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মসলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির প্রেক্ষাপটে এখন সময় এসেছে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার—কোনো দেশ থেকে মসলা আমদানি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হতে পারে।
বর্তমান মসলা আমদানির চিত্র
বাংলাদেশ সাধারণত ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা থেকে হলুদ, শুকনা মরিচ, আদা, জিরা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গসহ বিভিন্ন মসলা আমদানি করে। এর মধ্যে ভারতের ওপর নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে সীমান্তসংক্রান্ত জটিলতা, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ভারত: দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতার চ্যালেঞ্জ
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মসলা উৎপাদক ও রপ্তানিকারক। বাংলাদেশে ভারতীয় মসলার জনপ্রিয়তা ব্যাপক, বিশেষ করে তেলযুক্ত শুকনা মরিচ ও গুঁড়া হলুদ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়া, রপ্তানি শুল্ক আরোপ ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন এই নির্ভরতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। ভারতের হঠাৎ রপ্তানি বন্ধের প্রবণতা বাংলাদেশের বাজারে সরবরাহঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চীন: সরবরাহ ঠিক থাকলেও স্বাদ ও মানের প্রশ্ন
চীন থেকে বেশ কিছু কমদামি মসলা, বিশেষ করে শুকনা আদা ও প্যাকেটজাত গুঁড়া মসলা আসে। তবে এর স্বাদ, ঘ্রাণ ও গুণগত মান নিয়ে বাংলাদেশের বাজারে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া চীনের খাদ্যনিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্দেহ থাকায় দীর্ঘমেয়াদে চীনের ওপর নির্ভরতা তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম: সম্ভাবনাময় বিকল্প
ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম বিশ্বের বড় মসলা উৎপাদক। এ দুই দেশ থেকে দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, পিপার, শুকনা আদা ও নানা ধরনের গুঁড়া মসলা তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে আমদানি করা সম্ভব। বিশেষ করে ভিয়েতনামের কৃষিশিল্পে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য ভরসার যোগান দিতে পারে। এই দেশদুটির সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করলে মসলা আমদানিতে টেকসই বিকল্প গড়ে উঠতে পারে।
শ্রীলঙ্কা: গুণমান ভালো, তবে সরবরাহ সীমিত
শ্রীলঙ্কা থেকে এলাচ, দারুচিনি ও লবঙ্গসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট মসলা আসে। গুণগতমান ভালো ও দক্ষিণ এশীয় স্বাদসঙ্গত হলেও দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকট সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। পাশাপাশি উৎপাদন সীমিত হওয়ায় বাংলাদেশের বড় বাজারের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হতে পারে।
মিয়ানমার: ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক, কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি
প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে শুকনা মরিচ, আদা ও হলুদ আমদানি করা হয়। ভৌগোলিক নিকটতার কারণে পরিবহন খরচ কম হলেও দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
আফ্রিকার কিছু দেশ: নতুন উৎস হিসেবে সম্ভাবনা
ইথিওপিয়া, উগান্ডা, নাইজেরিয়া ও তানজানিয়ার মতো আফ্রিকান দেশ থেকে গোলমরিচ, এলাচ ও দারুচিনি আমদানি করা সম্ভব। ভৌগোলিক দূরত্ব ও পরিবহনব্যয় বেশি হলেও উৎসবৈচিত্র্য আনতে ও নির্ভরতা কমাতে এসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে।
কোনো দেশ সবচেয়ে উপযোগী?
ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের জন্য মসলা আমদানির সবচেয়ে উপযুক্ত গন্তব্য বলে প্রতীয়মান, কারণ—
- উৎপাদন নির্ভরযোগ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর
- গুণগতমান উন্নত ও রপ্তানিমুখী মনোভাব
- রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্থিতিশীলতা
- তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী মূল্য
শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশকে বিকল্প উৎস হিসেবে রাখা যেতে পারে, তবে ভারতের ওপর একক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল নেওয়া সময়ের দাবি।
আমদানি বৈচিত্র্য ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি জরুরি
বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি আমদানিকারকদের ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি জোরদার করে শুল্কসুবিধা নিশ্চিত করা উচিত। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকাকে বিকল্প উৎস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে বৈচিত্র্যময় আমদানি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে মসলার বাজার স্থিতিশীল থাকবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।