নদীর উৎস ও প্রবাহ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত হালদা নদী একটি অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যার উৎস খাগড়াছড়ির বদরমোকামে। এখান থেকে নদীটি ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান এবং বোয়ালখালী উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮১ কিলোমিটার, আর গড় প্রস্থ প্রায় ৩০ মিটার। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মিঠা পানির মাছের ডিম আহরণকারী নদী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
৩০০ বছর আগের জীববৈচিত্র্য
প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ বছর আগেও হালদা নদী ছিল এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের আধার। তখন নদীজুড়ে দেখা যেত রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, বোয়াল, আইড়, গজার, পাবদা, শোল, টেংরা, চিতলসহ প্রায় ৭০ থেকে ৮০ প্রজাতির মাছ। শুধু তাই নয়, এ নদীতে পাওয়া যেত বিরল প্রজাতির ডলফিন এবং জলচর পাখিরাও এখানে বিচরণ করত।
নদীর স্বচ্ছতা, স্রোতের গতি, তলদেশের উপযুক্ততা এবং খনিজ বৈশিষ্ট্যের কারণে মা মাছেরা হালদাকে ডিম ছাড়ার জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নিত। প্রতি বছর চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত মা রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় মাছ হালদার স্রোতে এসে ডিম ছাড়ে। স্থানীয় জেলেরা সেসব ডিম সংগ্রহ করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদন করে সারাদেশে সরবরাহ করতেন।
প্রজনন ঋতুতে হালদায় মাছ কেন আসে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, হালদা নদীর পানির তাপমাত্রা, গভীরতা, অক্সিজেনের মাত্রা, পলি গঠনের ধরণ এবং ধীরে প্রবাহিত হওয়া—এই সবগুলোই একত্রে এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করে, যা দেশীয় কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য আদর্শ। এছাড়া কর্ণফুলীর সঙ্গে সংযোগ থাকার ফলে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটার প্রভাবে এই নদীতে তৈরি হয় বিশেষ প্রাকৃতিক ছন্দ, যা মাছের প্রজনন প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে।
জীববৈচিত্র্যের অবনতি: কবে থেকে শুরু?
গত দুই দশকে হালদার জীববৈচিত্র্যে বড় ধরনের অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। ২০০০ সালের পর থেকে আশেপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ শিল্প, চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ফেলা, পাড়ভাঙন, নাব্যতা হ্রাস এবং অপরিকল্পিত বাঁধনির্মাণের কারণে নদীটির বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে আজ হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। ১৯৪৫ সালে যখন প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ডিম সংগ্রহ শুরু হয়, তখন প্রতি মৌসুমে ২০ হাজার কেজি পর্যন্ত ডিম পাওয়া যেত। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১,০০০ থেকে ২,০০০ কেজিতে।
বর্তমানে হালদার অবস্থা
বর্তমানে হালদা একটি সংকটাপন্ন নদী হিসেবে চিহ্নিত। নদীর পানির রং বদলে গেছে, ডলফিনের উপস্থিতি কমে গেছে, মাছের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের বিস্তৃত আবাসিক অঞ্চল ও শিল্প এলাকা থেকে হালদার তীরে চলে আসা আবর্জনা, রাসায়নিক বর্জ্য এবং নৌযানের তেল নদীর জলে মিশে হুমকি তৈরি করছে। যদিও সরকার হালদাকে ‘জীবন্ত প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করেছে, তবুও আইনের প্রয়োগ এখনও পর্যাপ্ত নয়।
দুই পাড়ের সভ্যতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য
হালদার দুই তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এক গভীর কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজানের কৃষকেরা হালদার পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ করেন। মাছ ধরা এবং ডিম সংগ্রহ ছিল এখানকার বড় পেশাগত উৎস। নৌপথের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় নদীটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও একসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধান, শাকসবজি, মাছ, কাঠ, ইট ইত্যাদি নৌকায় বহন করে শহরে সরবরাহ হতো।
বর্তমানে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় বড় নৌযান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। তবে ছোট নৌকা এবং ট্রলার এখনও স্থানীয় পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
হালদা নদী ও সংস্কৃতি
হালদা নদীকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। নদীর পাড়ে গাওয়া হয় হালদার গান, যেমন—
“হালদা নদীর পানি রে ভাই,
জোনাকির মতো জ্বলে,
এই নদী মা রুই কাতলার,
সুখের পোনা ফলে।”
নদীকে নিয়ে স্থানীয় কবিতা, পালা, উপাখ্যান এবং গ্রামীণ নাটকের রচনা রয়েছে। চট্টগ্রামের সাহিত্যেও হালদা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে—যেখানে নদী শুধুই পানি নয়, বরং জীবনের অনুষঙ্গ, স্মৃতির বাহক এবং জাতিসত্তার ধারক।
হালদা রক্ষায় করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হালদাকে রক্ষায় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, গবেষক, পরিবেশবিদ এবং জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন—
- শিল্পবর্জ্য নির্গমন বন্ধ করা
- পাড়ভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ
- মা মাছ শিকার বন্ধে কঠোর নজরদারি
- জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন
- স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ-সচেতনতা বাড়ানো
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য
হালদা শুধু একটি নদী নয়, এটি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও কৃষিনির্ভর জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই নদীর প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি কণিকায় জড়িয়ে আছে ইতিহাস, জীবন আর ভবিষ্যৎ। হালদাকে রক্ষা করা মানেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনের ধারাকে রক্ষা করা।