কবরী: এক কিংবদন্তির জন্মদিন
তিন দিন আগে ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের অমর নায়িকা কবরী সারোয়ার-এর জন্মদিন। তিনি শুধু একজন অভিনেত্রী নন—তিনি ছিলেন ষাট, সত্তর ও আশির দশকের রূপালি পর্দার এক আবেগ, এক ভালোবাসা। কবরীর জন্মদিনে আমরা ফিরে দেখি তাঁর অভিনীত কিছু বিস্ময়কর ও হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য, যা আজও বাংলার দর্শক ভুলতে পারেননি।
‘সুতরাং’ (১৯৬৪): নতুন নায়িকার বিস্ময়কর আত্মপ্রকাশ
কবরীর প্রথম ছবি ‘সুতরাং’—যেখানে তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে নায়ক সুভাষ দত্তের বিপরীতে অভিনয় করেন। একেবারে সাধারণ বাঙালি মেয়ের সাজে, তাঁর নিঃসঙ্গতা, প্রেম এবং অভিমান ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা ছিল অনবদ্য। বিশেষভাবে একটি দৃশ্যে, যখন তাঁর চোখে জল এসে যায় প্রেমিকের উপেক্ষায়—এই নীরব অভিনয় তাঁকে রাতারাতি তারকা করে তোলে।
‘জলছবি’ (১৯৬৫): গ্রামীণ মেয়ের সরলতা ও স্নিগ্ধতা
‘জলছবি’তে কবরীর চরিত্র ছিল গ্রামের এক সরল মেয়ে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, তিনি তাঁর প্রেমিকের জন্য পুকুরে জল আনছেন—সেখানে তাঁর চাহনি, হাসি ও শরীরী ভাষায় ছিল এক দুর্লভ স্নিগ্ধতা। এই দৃশ্যটি এখনো চলচ্চিত্র বিশারদদের কাছে বাংলাদেশের অন্যতম রোমান্টিক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত।
‘সারেং বউ’ (১৯৭৮): নারীর আত্মত্যাগ ও অপেক্ষার গভীরতা
‘সারেং বউ’ ছবিতে কবরী একজন জাহাজির স্ত্রী। তাঁর স্বামী সমুদ্রযাত্রায় গেলে তিনি অনন্ত অপেক্ষায় থাকেন। এক অসাধারণ দৃশ্যে কবরী সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় জানালায় বসে একা কথা বলছিলেন—“সে আজও ফিরল না”—এই সংলাপ ও মুখাবয়বের গভীর অভিব্যক্তি বহু দর্শকের চোখে জল এনে দেয়। এই অভিনয়ে তাঁর সংবেদনশীলতা এবং চরিত্রের গভীরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘নীল আকাশের নিচে’ (১৯৬৯): প্রেম ও বেদনার দ্বৈত রূপ
এই ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর জুটির অনবদ্য রসায়ন এখনো স্মরণীয়। একটি দৃশ্যে, যেখানে কবরী রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে প্রেমিককে বিদায় জানাচ্ছেন—তাঁর চোখের ভাষা, ভাঙা কণ্ঠস্বর এবং শরীরী ভাষা এক অপূর্ব সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। সেই সময়কার দর্শকদের অনেকেই কেঁদে উঠেছিলেন এই দৃশ্য দেখে।
‘অপরাজেয়’ (১৯৭০): বিপ্লবী কবরীর অনবদ্য রূপ
কবরী কেবল প্রেমিকা নন, একজন সচেতন, সংগ্রামী নারীকেও পর্দায় উপস্থাপন করেছিলেন। ‘অপরাজেয়’ ছবিতে তিনি সমাজের অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এক নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। আদালতের দৃশ্যে তাঁর আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ—“আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবই”—আজও নারী-শক্তির প্রতীক হয়ে রয়েছে।
ব্যক্তিত্ব ও অভিব্যক্তির অনন্য সংমিশ্রণ
কবরীর অভিনয়ের মূল শক্তি ছিল তাঁর চোখের ভাষা এবং মুখাবয়বের সূক্ষ্ম পরিবর্তন। তিনি চিৎকার করে নয়, নীরবতায় অভিনয় করতেন—যেখানে একটুকরো হাসি বা চোখের জল হয়ে উঠত একেকটি সংলাপ। এ কারণেই তাঁর অভিনীত প্রতিটি দৃশ্য ছিল বাস্তবের মতো জীবন্ত।
জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
কবরী আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর অভিনীত অসংখ্য মুহূর্ত আমাদের স্মৃতির অম্লান অংশ হয়ে আছে। তাঁর জন্মদিনে আমাদের প্রার্থনা—এই মহান শিল্পীর আত্মা শান্তিতে থাকুক। তাঁর অভিনীত দৃশ্যগুলো যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলা সিনেমার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে থাকে।
যে দৃশ্য আমাদের কাঁদিয়েছে
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কবরী এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর অভিনীত অসাধারণ কিছু দৃশ্য যেমন আমাদের কাঁদিয়েছে, তেমনি আশাবাদীও করেছে। আজকের দিনেও যখন আমরা ভালো অভিনয়ের অভাব দেখি, তখন কবরীর মতো কিংবদন্তির কাজগুলো এক আশার আলো হয়ে দেখা দেয়। তাঁর জন্মদিনে আমরা শুধু তাঁর জীবন নয়, তাঁর শিল্পকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।