০৬:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমাদের হঠাৎ ঘুম পেয়ে যায় কেন: মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতরের সতর্ক সংকেত

ভূমিকা: ঘুম – আচরণ নয়সুরক্ষাব্যবস্থা

ঘুমকে আমরা সাধারণত শরীরকে “বিশ্রাম” দেওয়া এক স্বাভাবিক রুটিন ভাবি। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে—ঘুম আসা নিজেই মস্তিষ্কের এক সক্রিয় প্রতিরক্ষা কৌশল। দিনের বেলা সজাগ, চিন্তাশীল ও কর্মব্যস্ত থাকার ফলে কোষের ভেতরের শক্তিকেন্দ্র মাইটোকন্ড্রিয়ায় ইলেকট্রন প্রবাহে সূক্ষ্ম ভারসাম্যহীনতা জমতে থাকে। এ ভারসাম্যহীনতা যখন ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করে, তখন কিছু বিশেষ নিউরন যেন “সার্কিট ব্রেকার” চাপ দিয়ে আমাদের ঘুমের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে ঘুম কেবল আরাম নয়; এটি শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বাধ্যতামূলক মেরামত পর্ব।

পুরনো ব্যাখ্যা বনাম নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

দীর্ঘদিন ঘুমচাপের (sleep pressure) মূল ব্যাখ্যা ছিল দুইটি প্রধান ধারণায়: (১) মস্তিষ্কে অ্যাডেনোসিন জমা হয়ে ঘুমের তাগিদ বাড়ায় এবং (২) সারাদিন সিন্যাপটিক সংযোগ সক্রিয় ও পুনর্গঠনের চাপে “বিশ্রাম” দরকার হয়। নতুন পরীক্ষণ এই কাঠামোকে প্রসারিত করেছে—দেখাচ্ছে, ইলেকট্রন লিক ও জমা থেকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষতিই আসলে নিউরনকে ঘুম ট্রিগার করার সুনির্দিষ্ট সংকেত দেয়। অর্থাৎ রসায়নীয় জমা (অ্যাডেনোসিন) ও কাঠামোগত প্রয়োজনে (সিন্যাপস পুনর্গঠন) যে ব্যাখ্যা ছিল, তার অভ্যন্তরে আরও “প্রাথমিক স্তরে” দাঁড়িয়ে আছে শক্তি বিপাকের মাইক্রো সংকেত।

মাইটোকন্ড্রিয়া: কোষের শক্তি কারখানার নীরব ঝুঁকি

মাইটোকন্ড্রিয়া খাদ্যজাত অণু ভেঙে ATP নামের শক্তি “মুদ্রা” তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলে (electron transport chain) সামান্য লিক হয়ে উচ্চ প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেনজাত কণা (Reactive Oxygen Species) জন্ম নিতে পারে। খুব অল্প পরিমাণে তা সংকেতের অংশ, কিন্তু অতিরিক্ত হলে প্রোটিন, লিপিড ও ডিএনএ ক্ষয় করে। গবেষণায় দেখা যায়, কিছু ঘুম‑নিয়ন্ত্রণকারী নিউরনে এ ক্ষতি সীমার দিকে এগোলেই মাইটোকন্ড্রিয়া ভেঙে (fragmentation) টুকরো টুকরো হয়—এক সতর্ক চিহ্ন। ঘুম আরম্ভ হতেই সেই ভাঙা অংশগুলো আবার জুড়ে (fusion) স্বাভাবিক গঠন ফিরে পায়। যেন রাতের ঘুম হলো কোষীয় “ওভারহল” শিফট।

ফলমাছি মডেল: ক্ষুদ্র প্রাণীতে বৃহৎ অন্তর্দৃষ্টি

ফলমাছি একটি আদর্শ ল্যাবরেটরি প্রাণী—স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে সূক্ষ্ম জেনেটিক পরীক্ষা সহজ। গবেষক দল ঘুম‑নিয়ন্ত্রণকারী dFBNs নিউরন আলোকিত মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে প্রথমে তাদের স্বাভাবিক ছন্দ নথিভুক্ত করেন। এরপর নির্দিষ্ট সময় (প্রায় বারো ঘণ্টা) ঘুম থেকে বঞ্চিত রাখলে দেখা যায়—মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ভেঙে আইলে‑পাইলের ছোট খণ্ড। পরের ধাপ: ঘুমের স্বাধীন সুযোগ দিলে সেই একই নিউরনের মাইটোকন্ড্রিয়া পুনরায় জোড়া লাগে। ফলে আচরণগত পরিবর্তন (ঘুম) ও অঙ্গাণু মেরামতের (উন্নত ফিউশন) একটি ধারাবাহিক কারণসূত্র দৃশ্যমান হয়।

ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপে কারণ প্রমাণ

পর্যবেক্ষণকে কারণ প্রমাণে রূপ দিতে গবেষকেরা dFBNs নিউরনে এমন একটি আলোসংবেদী প্রোটিন সংযোজন করেন যা আলোর উপস্থিতিতে ইলেকট্রন প্রবাহের স্বাভাবিক ধাপ বিঘ্নিত করে। ফল: ঘুম‑বঞ্চিত না থাকা অবস্থাতেও আলোক উদ্দীপনা পাওয়ার পর পরীক্ষাগোষ্ঠী দ্রুততর ঘুমে ঢুকে পড়ে। এই “শর্টকাট” দেখায়—ইলেকট্রন ভারসাম্য ইচ্ছাকৃতভাবে নাড়া দিলেই ঘুমচাপ কৃত্রিমভাবে উত্থিত হতে পারে। অর্থাৎ ইলেকট্রনজনিত চাপ শুধু সহগামী নয়, প্ররোচনামূলক।

What is Excessive Daytime Sleepiness? Sleepiness vs. Fatigue | Casper Blog

মানবিক প্রতিধ্বনি: রোগক্লান্তি ও সম্ভাবনা

মানুষের মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়াল ব্যাধি বা কিছু স্নায়বিক অবস্থায় রোগীরা অস্বাভাবিক ক্লান্তি, দিনের বেলায় বারবার ঘুমভাব, বা মনোসংযোগে ঘাটতির অভিজ্ঞতা জানান। যদি মস্তিষ্কের ঘুম‑সুইচ আসলে মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষতির সেন্সর হয়, তবে অনিদ্রা, হাইপারসোমনিয়া, শিফট‑কর্মীর ঘুম ব্যাধি, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সিনড্রোম ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ নতুন লক্ষ্য (target) তৈরি হয়—“শক্তি কারখানার মাইক্রো‑মেরামত” দ্রুততর করা বা ক্ষতিকর ইলেকট্রন লিক প্রতিরোধ করা।

সম্ভাব্য বায়োমার্কার ও চিকিৎসা নকশা

১. বায়োমার্কার উন্নয়ন: মাইটোকন্ড্রিয়াল ফ্র্যাগমেন্টেশন হার পরিমাপ বা অক্সিডেটিভ মার্কার স্কোর ঘুমচাপের উদ্দেশ্যসূচক মানদণ্ড দিতে পারে।
২. নতুন ওষুধ: ROS নিরপেক্ষক অণু বা ফিউশন‑প্রণোদক যৌগ দিয়ে “গভীর পুনরুদ্ধার ঘুম” আনার লক্ষ্যভিত্তিক থেরাপি সম্ভব।
৩. ব্যক্তিগতকৃত ঘুম পরিকল্পনা: শিফট কর্মী, পাইলট, বা আন্তর্জাতিক সময়-ভ্রমণকারীর জন্য মাইটোকন্ড্রিয়া‑সহায়ক (mito-supportive) রুটিন—যেমন নির্দিষ্ট আলোক এক্সপোজার, খাদ্য টাইমিং, সম্ভাব্য সাপ্লিমেন্ট—প্রণয়ন করা যেতে পারে।
৪. প্রতিরোধমূলক কৌশল: রাতে পর্যাপ্ত (প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে সাধারণত সাত থেকে আট ঘণ্টা) ঘুম নিশ্চিত করা শুধু সতেজতার নয়, স্নায়ুঘটিত ক্ষয় কমানোর বিনিয়োগ।

বিজ্ঞান সাংবাদিকতার অনুষঙ্গ

একই ধারার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে অবদান রাখছে—যেখানে জটিল স্নায়ুবৈজ্ঞানিক বিপাককে সাধারণ পাঠকের বোধগম্য কাঠামোতে আনা হয়। ফলে জনস্বাস্থ্যবার্তা (“পর্যাপ্ত ঘুম নিন”) শুধু উপদেশ নয়, কোষীয় প্রমাণনির্ভর পর্যবেক্ষণে দাঁড়িয়ে যায়।

Insomnia Sucks! How Are Your Sleeping Habits? | by Michael Trigg | Mind Talk | Medium

সমাজ ও নীতি: কর্মসংস্কৃতি পুনর্মূল্যায়ন

অতিরিক্ত সময় কাজ, রাতজাগা সংস্কৃতি বা “সর্বদা অনলাইন” প্রবণতা বাস্তবে মস্তিষ্কের শক্তি কারখানার ক্ষুদ্র ক্ষতি জমতে দেওয়ার মতো। কর্মনীতি (shift scheduling), বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের শুরুর সময়, হাসপাতালের ডিউটি রোস্টার পুনর্বিবেচনা—সবই এই দৃষ্টিতে নতুন তাৎপর্য পায়। ঘুমকে বিলাস নয়, অবকাঠামোগত প্রয়োজন (infrastructure of recovery) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জনস্বাস্থ্য ব্যয়ের দীর্ঘমেয়াদি চাপ কমাতে পারে।

সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ প্রশ্ন

গবেষণা এখনো প্রধানত ফলমাছি ও সীমিত স্তন্যপায়ী ইঙ্গিতে নির্ভর। খোলা প্রশ্ন রয়ে গেছে:

  • ঠিক কোন মাত্রার ইলেকট্রন লিক ঘুম ট্রিগারের থ্রেশহোল্ড?
  • মানুষের বিভিন্ন মস্তিষ্ক অঞ্চলে কি একই সেন্সর ব্যবস্থা সক্রিয়?
  • দীর্ঘস্থায়ী ঘুমঘাটতি কি মাইটোকন্ড্রিয়ার স্থায়ী পুনর্গঠন (maladaptive remodeling) ঘটায়?
    এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে উচ্চ রেজোলিউশন ইমেজিং, একক কোষ বিপাকীয় মাপ (single‑cell metabolomics) ও নন‑ইনভেসিভ বায়োমার্কার উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।

 ঘুম নিন”—একটি কোষীয় আজ্ঞা

নতুন প্রমাণ ঘুমকে শক্তি বিপাকের রক্ষণাবেক্ষণ প্রটোকল হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে। ঘুম না এলে যেভাবে ডিভাইস অতিরিক্ত উত্তাপে ক্র্যাশ করতে পারে, তেমনি যথাযথ ঘুম না পেলে মস্তিষ্কের শক্তি কারখানা ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। সুতরাং নিয়মিত পর্যাপ্ত, মানসম্মত ঘুম শুধু কর্মক্ষমতা নয়—দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুস্বাস্থ্যের বিনিয়োগ, যেখানে প্রতিটি রাত ইলেকট্রন প্রবাহের ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করে আমাদের চিন্তা, স্মৃতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চকে স্থিত রাখে।

আমাদের হঠাৎ ঘুম পেয়ে যায় কেন: মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতরের সতর্ক সংকেত

১২:৩০:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

ভূমিকা: ঘুম – আচরণ নয়সুরক্ষাব্যবস্থা

ঘুমকে আমরা সাধারণত শরীরকে “বিশ্রাম” দেওয়া এক স্বাভাবিক রুটিন ভাবি। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে—ঘুম আসা নিজেই মস্তিষ্কের এক সক্রিয় প্রতিরক্ষা কৌশল। দিনের বেলা সজাগ, চিন্তাশীল ও কর্মব্যস্ত থাকার ফলে কোষের ভেতরের শক্তিকেন্দ্র মাইটোকন্ড্রিয়ায় ইলেকট্রন প্রবাহে সূক্ষ্ম ভারসাম্যহীনতা জমতে থাকে। এ ভারসাম্যহীনতা যখন ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করে, তখন কিছু বিশেষ নিউরন যেন “সার্কিট ব্রেকার” চাপ দিয়ে আমাদের ঘুমের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে ঘুম কেবল আরাম নয়; এটি শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বাধ্যতামূলক মেরামত পর্ব।

পুরনো ব্যাখ্যা বনাম নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

দীর্ঘদিন ঘুমচাপের (sleep pressure) মূল ব্যাখ্যা ছিল দুইটি প্রধান ধারণায়: (১) মস্তিষ্কে অ্যাডেনোসিন জমা হয়ে ঘুমের তাগিদ বাড়ায় এবং (২) সারাদিন সিন্যাপটিক সংযোগ সক্রিয় ও পুনর্গঠনের চাপে “বিশ্রাম” দরকার হয়। নতুন পরীক্ষণ এই কাঠামোকে প্রসারিত করেছে—দেখাচ্ছে, ইলেকট্রন লিক ও জমা থেকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষতিই আসলে নিউরনকে ঘুম ট্রিগার করার সুনির্দিষ্ট সংকেত দেয়। অর্থাৎ রসায়নীয় জমা (অ্যাডেনোসিন) ও কাঠামোগত প্রয়োজনে (সিন্যাপস পুনর্গঠন) যে ব্যাখ্যা ছিল, তার অভ্যন্তরে আরও “প্রাথমিক স্তরে” দাঁড়িয়ে আছে শক্তি বিপাকের মাইক্রো সংকেত।

মাইটোকন্ড্রিয়া: কোষের শক্তি কারখানার নীরব ঝুঁকি

মাইটোকন্ড্রিয়া খাদ্যজাত অণু ভেঙে ATP নামের শক্তি “মুদ্রা” তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলে (electron transport chain) সামান্য লিক হয়ে উচ্চ প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেনজাত কণা (Reactive Oxygen Species) জন্ম নিতে পারে। খুব অল্প পরিমাণে তা সংকেতের অংশ, কিন্তু অতিরিক্ত হলে প্রোটিন, লিপিড ও ডিএনএ ক্ষয় করে। গবেষণায় দেখা যায়, কিছু ঘুম‑নিয়ন্ত্রণকারী নিউরনে এ ক্ষতি সীমার দিকে এগোলেই মাইটোকন্ড্রিয়া ভেঙে (fragmentation) টুকরো টুকরো হয়—এক সতর্ক চিহ্ন। ঘুম আরম্ভ হতেই সেই ভাঙা অংশগুলো আবার জুড়ে (fusion) স্বাভাবিক গঠন ফিরে পায়। যেন রাতের ঘুম হলো কোষীয় “ওভারহল” শিফট।

ফলমাছি মডেল: ক্ষুদ্র প্রাণীতে বৃহৎ অন্তর্দৃষ্টি

ফলমাছি একটি আদর্শ ল্যাবরেটরি প্রাণী—স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে সূক্ষ্ম জেনেটিক পরীক্ষা সহজ। গবেষক দল ঘুম‑নিয়ন্ত্রণকারী dFBNs নিউরন আলোকিত মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে প্রথমে তাদের স্বাভাবিক ছন্দ নথিভুক্ত করেন। এরপর নির্দিষ্ট সময় (প্রায় বারো ঘণ্টা) ঘুম থেকে বঞ্চিত রাখলে দেখা যায়—মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ভেঙে আইলে‑পাইলের ছোট খণ্ড। পরের ধাপ: ঘুমের স্বাধীন সুযোগ দিলে সেই একই নিউরনের মাইটোকন্ড্রিয়া পুনরায় জোড়া লাগে। ফলে আচরণগত পরিবর্তন (ঘুম) ও অঙ্গাণু মেরামতের (উন্নত ফিউশন) একটি ধারাবাহিক কারণসূত্র দৃশ্যমান হয়।

ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপে কারণ প্রমাণ

পর্যবেক্ষণকে কারণ প্রমাণে রূপ দিতে গবেষকেরা dFBNs নিউরনে এমন একটি আলোসংবেদী প্রোটিন সংযোজন করেন যা আলোর উপস্থিতিতে ইলেকট্রন প্রবাহের স্বাভাবিক ধাপ বিঘ্নিত করে। ফল: ঘুম‑বঞ্চিত না থাকা অবস্থাতেও আলোক উদ্দীপনা পাওয়ার পর পরীক্ষাগোষ্ঠী দ্রুততর ঘুমে ঢুকে পড়ে। এই “শর্টকাট” দেখায়—ইলেকট্রন ভারসাম্য ইচ্ছাকৃতভাবে নাড়া দিলেই ঘুমচাপ কৃত্রিমভাবে উত্থিত হতে পারে। অর্থাৎ ইলেকট্রনজনিত চাপ শুধু সহগামী নয়, প্ররোচনামূলক।

What is Excessive Daytime Sleepiness? Sleepiness vs. Fatigue | Casper Blog

মানবিক প্রতিধ্বনি: রোগক্লান্তি ও সম্ভাবনা

মানুষের মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়াল ব্যাধি বা কিছু স্নায়বিক অবস্থায় রোগীরা অস্বাভাবিক ক্লান্তি, দিনের বেলায় বারবার ঘুমভাব, বা মনোসংযোগে ঘাটতির অভিজ্ঞতা জানান। যদি মস্তিষ্কের ঘুম‑সুইচ আসলে মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষতির সেন্সর হয়, তবে অনিদ্রা, হাইপারসোমনিয়া, শিফট‑কর্মীর ঘুম ব্যাধি, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সিনড্রোম ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ নতুন লক্ষ্য (target) তৈরি হয়—“শক্তি কারখানার মাইক্রো‑মেরামত” দ্রুততর করা বা ক্ষতিকর ইলেকট্রন লিক প্রতিরোধ করা।

সম্ভাব্য বায়োমার্কার ও চিকিৎসা নকশা

১. বায়োমার্কার উন্নয়ন: মাইটোকন্ড্রিয়াল ফ্র্যাগমেন্টেশন হার পরিমাপ বা অক্সিডেটিভ মার্কার স্কোর ঘুমচাপের উদ্দেশ্যসূচক মানদণ্ড দিতে পারে।
২. নতুন ওষুধ: ROS নিরপেক্ষক অণু বা ফিউশন‑প্রণোদক যৌগ দিয়ে “গভীর পুনরুদ্ধার ঘুম” আনার লক্ষ্যভিত্তিক থেরাপি সম্ভব।
৩. ব্যক্তিগতকৃত ঘুম পরিকল্পনা: শিফট কর্মী, পাইলট, বা আন্তর্জাতিক সময়-ভ্রমণকারীর জন্য মাইটোকন্ড্রিয়া‑সহায়ক (mito-supportive) রুটিন—যেমন নির্দিষ্ট আলোক এক্সপোজার, খাদ্য টাইমিং, সম্ভাব্য সাপ্লিমেন্ট—প্রণয়ন করা যেতে পারে।
৪. প্রতিরোধমূলক কৌশল: রাতে পর্যাপ্ত (প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে সাধারণত সাত থেকে আট ঘণ্টা) ঘুম নিশ্চিত করা শুধু সতেজতার নয়, স্নায়ুঘটিত ক্ষয় কমানোর বিনিয়োগ।

বিজ্ঞান সাংবাদিকতার অনুষঙ্গ

একই ধারার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে অবদান রাখছে—যেখানে জটিল স্নায়ুবৈজ্ঞানিক বিপাককে সাধারণ পাঠকের বোধগম্য কাঠামোতে আনা হয়। ফলে জনস্বাস্থ্যবার্তা (“পর্যাপ্ত ঘুম নিন”) শুধু উপদেশ নয়, কোষীয় প্রমাণনির্ভর পর্যবেক্ষণে দাঁড়িয়ে যায়।

Insomnia Sucks! How Are Your Sleeping Habits? | by Michael Trigg | Mind Talk | Medium

সমাজ ও নীতি: কর্মসংস্কৃতি পুনর্মূল্যায়ন

অতিরিক্ত সময় কাজ, রাতজাগা সংস্কৃতি বা “সর্বদা অনলাইন” প্রবণতা বাস্তবে মস্তিষ্কের শক্তি কারখানার ক্ষুদ্র ক্ষতি জমতে দেওয়ার মতো। কর্মনীতি (shift scheduling), বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের শুরুর সময়, হাসপাতালের ডিউটি রোস্টার পুনর্বিবেচনা—সবই এই দৃষ্টিতে নতুন তাৎপর্য পায়। ঘুমকে বিলাস নয়, অবকাঠামোগত প্রয়োজন (infrastructure of recovery) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জনস্বাস্থ্য ব্যয়ের দীর্ঘমেয়াদি চাপ কমাতে পারে।

সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ প্রশ্ন

গবেষণা এখনো প্রধানত ফলমাছি ও সীমিত স্তন্যপায়ী ইঙ্গিতে নির্ভর। খোলা প্রশ্ন রয়ে গেছে:

  • ঠিক কোন মাত্রার ইলেকট্রন লিক ঘুম ট্রিগারের থ্রেশহোল্ড?
  • মানুষের বিভিন্ন মস্তিষ্ক অঞ্চলে কি একই সেন্সর ব্যবস্থা সক্রিয়?
  • দীর্ঘস্থায়ী ঘুমঘাটতি কি মাইটোকন্ড্রিয়ার স্থায়ী পুনর্গঠন (maladaptive remodeling) ঘটায়?
    এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে উচ্চ রেজোলিউশন ইমেজিং, একক কোষ বিপাকীয় মাপ (single‑cell metabolomics) ও নন‑ইনভেসিভ বায়োমার্কার উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।

 ঘুম নিন”—একটি কোষীয় আজ্ঞা

নতুন প্রমাণ ঘুমকে শক্তি বিপাকের রক্ষণাবেক্ষণ প্রটোকল হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে। ঘুম না এলে যেভাবে ডিভাইস অতিরিক্ত উত্তাপে ক্র্যাশ করতে পারে, তেমনি যথাযথ ঘুম না পেলে মস্তিষ্কের শক্তি কারখানা ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। সুতরাং নিয়মিত পর্যাপ্ত, মানসম্মত ঘুম শুধু কর্মক্ষমতা নয়—দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুস্বাস্থ্যের বিনিয়োগ, যেখানে প্রতিটি রাত ইলেকট্রন প্রবাহের ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করে আমাদের চিন্তা, স্মৃতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চকে স্থিত রাখে।