০৩:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

“হলি আর্টিজান” আইএস জঙ্গী হামলা : এক ক্ষত, যা আজও রক্তাক্ত

 এক রাতে বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ছোট্ট, শান্তিপূর্ণ হলি আর্টিজান বেকারিতে হঠাৎই ঘটে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী হামলা। পাঁচজন সশস্ত্র যুবক সেখানে প্রবেশ করে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। ভয়াবহ সেই রাতে ১৭ জন বিদেশিসহ মোট ২২ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইতালি, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাও প্রাণ দেন জঙ্গিদের হাত থেকে জিম্মিদের বাঁচাতে গিয়ে।

মানবিকতার বিপর্যয় এবং পরিবারগুলোর ভেঙে পড়া জীবন

এই হামলা শুধু হতাহতের পরিসংখ্যান নয়, অনেক পরিবারে আজীবনের জন্য এক শূন্যতা রেখে গেছে। বাংলাদেশি নিহতদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অবিন্তা কবির ও সিমুলতলা গ্রামের তরুণ ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসান। অবিন্তার মা রুবানা হক জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন:

“আমি আমার মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে হয়তো একজন বড় উদ্যোক্তা হবে, সমাজ বদলাবে। এখন শুধু শূন্যতা, প্রতিদিন চোখের পানি ছাড়া আর কিছু নেই।”

তবে শুধু দেশি নয়, নিহত বিদেশিদের পরিবারগুলোও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভীষণভাবে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন।

জাপানের সাতজন নাগরিক যারা একটি অবকাঠামোগত প্রকল্পে কাজ করতে এসেছিলেন, তাদের এক আত্মীয় Asahi Shimbun-এ বলেন:

“They came to help build Bangladesh’s future. But they were sent back home in coffins. It’s unacceptable.”

ইতালিভারতযুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া: শোকক্ষোভ ও প্রশ্ন

ইতালির ছয় নাগরিক নিহত হন, যাঁরা সবাই ছিলেন রপ্তানি পোশাক ও কাঁচামাল খাতে ক্রয়দলের সদস্য। তাঁদের পরিবার ও সহকর্মীরা La Repubblica ও Corriere della Sera-তে বলেন:

“আমাদের আত্মীয়েরা ব্যবসার জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বাস করেছিল, অথচ তাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায় নেয় না।”
“এটা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, আমাদের আস্থা এবং মানবতার ওপর আঘাত।”

ভারতীয় তরুণ তারিশি জৈনের পরিবার Times of India ও NDTV-তে বলেন:

“Tarishi was just 19. She was in Bangladesh on her summer break. We never thought this kind of brutality would happen to her in a friendly country like Bangladesh.”

 

যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আবদুল রাজ্জাকের পরিবারের সদস্যরা Washington Post-এ বলেন:

“Bangladesh was his home, his roots. And now we feel like even home is not safe anymore.”

জাতীয় মিডিয়ায় পরিবারগুলোর বিচার ও নিরাপত্তা প্রশ্ন

হামলার পরে নিহতদের পরিবার, বিশেষত বাংলাদেশি পরিবারগুলো বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়:

“সন্ত্রাসীদের গুলি না, অবহেলা ও ব্যর্থ নিরাপত্তা পরিকল্পনাই আমাদের সন্তানদের প্রাণ নিলো।”

পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়, হামলা ছিল সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পিত, এবং দেশীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখনো আন্তর্জাতিক স্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। তবুও, নিহত পুলিশ কর্মকর্তা সালাউদ্দিন ও রাশেদের আত্মত্যাগ নিয়ে অনেকে গর্ব প্রকাশ করেন, যা দেশজুড়ে বীরত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও পরিবারগুলোর উদ্বেগ

ঘটনার পর New York TimesBBCAl JazeeraCNN সহ বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশেষত বিদেশি নাগরিকদের হত্যা আন্তর্জাতিক ব্যবসা, উন্নয়ন সহযোগিতা ও বিনিয়োগে আস্থা সংকটে ফেলে দেয়। The Guardian-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়:

“This was not just a terrorist attack—it was an attack on Bangladesh’s global integration.”

এই হামলার পর বিশ্বব্যাপী অনেক এনজিও ও বাণিজ্য সংস্থা তাদের বাংলাদেশ কার্যক্রম স্থগিত বা সীমিত করে, যার ফলে অনেক বিদেশি নিহতদের পরিবার বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হতে আর আগ্রহ দেখাননি।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নিহতদের স্মরণ

ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদ দমন ও চরমপন্থা রোধে ব্যাপক অভিযান চালায়—“অপারেশন থান্ডারবোল্ট”-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্যাফেতে প্রবেশ করে জঙ্গিদের হত্যা করে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর ২০১৯ সালে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু নিহতদের পরিবারগুলো বলছেন, কেবল সাজা নয়, এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

নিহতদের স্মরণে ১ জুলাই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “হলি আর্টিজান দিবস” পালন শুরু করেছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের উপস্থিতিতে তাদের স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়।

রক্তাক্ত সেই রাত আজও জীবন্ত

“হলি আর্টিজান” শুধু একটি হামলা নয়, এটি একটি জাতির চোখ খুলে দেওয়ার মুহূর্ত। পরিবারগুলো আজও শোক বয়ে বেড়ায়, কিন্তু একইসঙ্গে তারা একটি নিরাপদ, সংহত ও সহনশীল বাংলাদেশ গঠনের জন্য সোচ্চার। তাদের মন্তব্য শুধু আবেগ নয়, একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা ও মানবতার সতর্কবার্তা।

এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়—একটি ভুল সিদ্ধান্ত, একটি দুর্বল নিরাপত্তা, একটি বিকৃত মতাদর্শ কতগুলো জীবন ও স্বপ্ন চিরতরে থামিয়ে দিতে পারে।

 

 

“হলি আর্টিজান” আইএস জঙ্গী হামলা : এক ক্ষত, যা আজও রক্তাক্ত

০৮:১০:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

 এক রাতে বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ছোট্ট, শান্তিপূর্ণ হলি আর্টিজান বেকারিতে হঠাৎই ঘটে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী হামলা। পাঁচজন সশস্ত্র যুবক সেখানে প্রবেশ করে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। ভয়াবহ সেই রাতে ১৭ জন বিদেশিসহ মোট ২২ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইতালি, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাও প্রাণ দেন জঙ্গিদের হাত থেকে জিম্মিদের বাঁচাতে গিয়ে।

মানবিকতার বিপর্যয় এবং পরিবারগুলোর ভেঙে পড়া জীবন

এই হামলা শুধু হতাহতের পরিসংখ্যান নয়, অনেক পরিবারে আজীবনের জন্য এক শূন্যতা রেখে গেছে। বাংলাদেশি নিহতদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অবিন্তা কবির ও সিমুলতলা গ্রামের তরুণ ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসান। অবিন্তার মা রুবানা হক জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন:

“আমি আমার মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে হয়তো একজন বড় উদ্যোক্তা হবে, সমাজ বদলাবে। এখন শুধু শূন্যতা, প্রতিদিন চোখের পানি ছাড়া আর কিছু নেই।”

তবে শুধু দেশি নয়, নিহত বিদেশিদের পরিবারগুলোও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভীষণভাবে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন।

জাপানের সাতজন নাগরিক যারা একটি অবকাঠামোগত প্রকল্পে কাজ করতে এসেছিলেন, তাদের এক আত্মীয় Asahi Shimbun-এ বলেন:

“They came to help build Bangladesh’s future. But they were sent back home in coffins. It’s unacceptable.”

ইতালিভারতযুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া: শোকক্ষোভ ও প্রশ্ন

ইতালির ছয় নাগরিক নিহত হন, যাঁরা সবাই ছিলেন রপ্তানি পোশাক ও কাঁচামাল খাতে ক্রয়দলের সদস্য। তাঁদের পরিবার ও সহকর্মীরা La Repubblica ও Corriere della Sera-তে বলেন:

“আমাদের আত্মীয়েরা ব্যবসার জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বাস করেছিল, অথচ তাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায় নেয় না।”
“এটা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, আমাদের আস্থা এবং মানবতার ওপর আঘাত।”

ভারতীয় তরুণ তারিশি জৈনের পরিবার Times of India ও NDTV-তে বলেন:

“Tarishi was just 19. She was in Bangladesh on her summer break. We never thought this kind of brutality would happen to her in a friendly country like Bangladesh.”

 

যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আবদুল রাজ্জাকের পরিবারের সদস্যরা Washington Post-এ বলেন:

“Bangladesh was his home, his roots. And now we feel like even home is not safe anymore.”

জাতীয় মিডিয়ায় পরিবারগুলোর বিচার ও নিরাপত্তা প্রশ্ন

হামলার পরে নিহতদের পরিবার, বিশেষত বাংলাদেশি পরিবারগুলো বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়:

“সন্ত্রাসীদের গুলি না, অবহেলা ও ব্যর্থ নিরাপত্তা পরিকল্পনাই আমাদের সন্তানদের প্রাণ নিলো।”

পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়, হামলা ছিল সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পিত, এবং দেশীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখনো আন্তর্জাতিক স্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। তবুও, নিহত পুলিশ কর্মকর্তা সালাউদ্দিন ও রাশেদের আত্মত্যাগ নিয়ে অনেকে গর্ব প্রকাশ করেন, যা দেশজুড়ে বীরত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও পরিবারগুলোর উদ্বেগ

ঘটনার পর New York TimesBBCAl JazeeraCNN সহ বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশেষত বিদেশি নাগরিকদের হত্যা আন্তর্জাতিক ব্যবসা, উন্নয়ন সহযোগিতা ও বিনিয়োগে আস্থা সংকটে ফেলে দেয়। The Guardian-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়:

“This was not just a terrorist attack—it was an attack on Bangladesh’s global integration.”

এই হামলার পর বিশ্বব্যাপী অনেক এনজিও ও বাণিজ্য সংস্থা তাদের বাংলাদেশ কার্যক্রম স্থগিত বা সীমিত করে, যার ফলে অনেক বিদেশি নিহতদের পরিবার বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হতে আর আগ্রহ দেখাননি।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নিহতদের স্মরণ

ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদ দমন ও চরমপন্থা রোধে ব্যাপক অভিযান চালায়—“অপারেশন থান্ডারবোল্ট”-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্যাফেতে প্রবেশ করে জঙ্গিদের হত্যা করে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর ২০১৯ সালে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু নিহতদের পরিবারগুলো বলছেন, কেবল সাজা নয়, এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

নিহতদের স্মরণে ১ জুলাই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “হলি আর্টিজান দিবস” পালন শুরু করেছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের উপস্থিতিতে তাদের স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়।

রক্তাক্ত সেই রাত আজও জীবন্ত

“হলি আর্টিজান” শুধু একটি হামলা নয়, এটি একটি জাতির চোখ খুলে দেওয়ার মুহূর্ত। পরিবারগুলো আজও শোক বয়ে বেড়ায়, কিন্তু একইসঙ্গে তারা একটি নিরাপদ, সংহত ও সহনশীল বাংলাদেশ গঠনের জন্য সোচ্চার। তাদের মন্তব্য শুধু আবেগ নয়, একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা ও মানবতার সতর্কবার্তা।

এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়—একটি ভুল সিদ্ধান্ত, একটি দুর্বল নিরাপত্তা, একটি বিকৃত মতাদর্শ কতগুলো জীবন ও স্বপ্ন চিরতরে থামিয়ে দিতে পারে।