শৈশব, পারিবারিক প্রেক্ষাপট ও অভিনয়ে আগ্রহ
বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় নায়িকা কবিতা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫২ সালের ৩১ মার্চ, ঢাকায়। তার প্রকৃত নাম কাজী সেলিনা। ছোটবেলা থেকেই তার পরিবারে সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিরাজ করতো। বাবা-মায়ের উৎসাহ ও পরিবারের স্নেহময় পরিবেশ তার শিল্পীসত্তাকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। তবে তার জীবনে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন, তিনি ছিলেন তার মামা—প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক জহির রায়হান। মামার মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ সহজ হয়।
অভিনয়ে পথচলা: প্রথম কাজ ও জনপ্রিয়তা
কবিতার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ১৯৬৭ সালে। তার প্রথম অভিনীত সিনেমা ছিল “কাছের মানুষ”। এতে তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করলেও সেখান থেকেই তার প্রতিভা নজর কাড়ে নির্মাতাদের। ১৯৭০ সালে নায়িকা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে সিনেমা “অবুঝ মন”-এর মাধ্যমে। এরপর “অন্তরাল”, “ভালোবাসার ঘর”, “রঙিন রূপবান”সহ অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমায় তিনি কাজ করেন।
তার অভিনয়ে ছিল সরলতা, আবেগ এবং আত্মস্থতা—যা তাকে খুব দ্রুত দর্শকের প্রিয় করে তোলে। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে তিনি ছিলেন ঢালিউডের অন্যতম ব্যস্ত নায়িকা।
পারিবারিক সম্পর্ক ও বিবাহ
কবিতা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক সোহেল রানার সঙ্গে। এই দম্পতির একটি পুত্রসন্তান রয়েছে—মৃধা তানভীর হাসান, যিনি ‘মনি’ নামে পরিচিত। যদিও ব্যক্তিজীবনে তাদের সম্পর্কে কিছু ওঠানামা ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তবে কোনো বড় ধরনের কেলেঙ্কারির খবর সংবাদমাধ্যমে আসেনি। ব্যক্তিজীবন বরাবরই তিনি আড়ালে রাখতে চেয়েছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
কবিতা তার অভিনয়ের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে একাধিক সম্মাননা লাভ করেছেন। যদিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বা একাডেমিক স্বীকৃতি তেমনটি পাননি, তবে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে একাধিক বার ‘মোস্ট পপুলার অ্যাকট্রেস’ হিসেবে অভিহিত করা হয় বেসরকারি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে।
বিজ্ঞাপন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থিতি
সত্তরের দশকে বাংলাদেশে যখন টেলিভিশনে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন শুরু হয়, তখন কবিতা কিছু হালকা প্রসাধনী ও খাদ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপনের কাজ করেন। যদিও তার বিজ্ঞাপনের কাজ চলচ্চিত্রের মতো আলোড়ন তোলেনি, তবুও তার উপস্থিতি সেখানে নজরকাড়া ছিল।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কবিতার উপস্থিতি সীমিত হলেও জানা যায়, তিনি দু-একবার বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালি সম্প্রদায়ের আয়োজন করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তবে এ নিয়ে খুব বেশি প্রচার হয়নি।
হঠাৎ অন্তরালে: কেন হারিয়ে গেলেন কবিতা?
আশির দশকের শেষ দিকে হঠাৎ করে কবিতা অভিনয় থেকে দূরে সরে যান। এর পেছনে একাধিক কারণ কাজ করেছিল। প্রথমত, চলচ্চিত্রের ধরণ ও গল্পের পরিবর্তন; দ্বিতীয়ত, পারিবারিক দায়িত্ব এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত; তৃতীয়ত, চলচ্চিত্রে একঘেয়েমি ও সময়োপযোগী চরিত্রের অভাব। এমন সময় অনেক অভিনেত্রীর মতো তিনিও পেছনে সরে যান। পরে কয়েকটি টিভি সাক্ষাৎকারে কবিতা বলেন, “সব সময় ক্যামেরার সামনে থাকাটা যে আনন্দের, তা ঠিক নয়। একজন মানুষ হিসেবে নিজের সময় দরকার হয়।”
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
কবিতা এখনো ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় পারিবারিকভাবে বসবাস করেন বলে জানা যায়। মাঝে মাঝে বিভিন্ন চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও তাকে বড় পর্দায় আর দেখা যায় না। অনেক তরুণী আজও কবিতাকে আদর্শ নায়িকা হিসেবে মনে করেন। অভিনয়ে তার সংযম, শালীনতা ও আবেগের প্রকাশ আজকের যুগেও অনুকরণযোগ্য।
কবিতার অভিনয়জীবন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। তার পথচলা ছিল অনুপ্রেরণার, আত্মত্যাগের ও শিল্পীসত্তার দ্যুতি ছড়ানোর। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রতিভা ও পারিবারিক সহায়তা একত্র হলে একজন নারীও হতে পারেন চলচ্চিত্রের শক্তিমান প্রতিনিধি। তিনি আজ পর্দায় অনুপস্থিত হলেও, স্মৃতির পর্দায় চিরকাল জীবন্ত থাকবেন।