তাজউদ্দিন আহমদ শুধু বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির ধারাবাহিক ইতিহাসের এক নেতা। বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্যে অন্যতম কারণ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্যকে বড় করে দেখা হয়— কিন্তু ইতিহাসের গভীরে গেলে দেখা যাবে পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে রয়েছে চল্লিশ দশকের বাঙালি তরুণ শিক্ষিত সম্প্রদায় ও তিরিশ দশকের বাঙালি তরুণ ও অসাম্প্রদায়িক মুসলিম যুবনেতাদের মনোজাগতিক পরিবর্তন।
শুধু তাজউদ্দিন আহমদ কেন বাংলাদেশের স্রষ্টা যে নেতারা এবং সর্বোপরি দেশ সৃষ্টির আন্দোলনের শীর্ষবিন্দু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ওইভাবে কোনো গবেষণা ও ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। বাস্তবে প্রকৃত ইতিহাসের জন্য যে কোনো জাতিকে শত শত বর্ষ অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, যে কোনো ঘটনার ভেতর দিয়ে অনেক ন্যারেটিভ ও অনেক মিথ জন্ম নেয়। সেইসব ঝেড়ে ফেলে তবেই হিরের খণ্ডের মতো ইতিহাসের মূল অংশটুকু থাকে। আর তার জন্যে সময়ই সবচেয়ে বড় নিয়ামক।
যেমন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে, তাদেরও প্রকৃত ইতিহাস কিন্তু এখনও লেখা হয়নি। এখন মানুষ প্রকৃত কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীকে জানে না। এখনও ভারতের মানুষ গান্ধী, সুভাষ বোস, চিত্তরঞ্জন দাশ, বল্লভভাই প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী— এমন অনেককে জানে না। তাদের প্রকৃত ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। এটাই পৃথিবীর বাস্তবতা।
তারপরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এই ভূখণ্ডের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের যে ইতিহাস সৃষ্টি হয় এ ইতিহাসের একটি দীর্ঘ পথ চলা আছে। সেখানে কামরুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম (প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) তাজউদ্দিন আহমদ, কমরেড তোয়াহা, অধ্যাপক আবুল কাসেম, অলি আহাদ— এমনই বড় বড় অনেক ফুলের নাম এ পথে আছে। তারা আমাদের দেশের স্রষ্টা।
চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিল আরও কয়েকটি প্রজন্মের প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃত্ব। আর এর সঙ্গে জন্ম নিয়েছিল প্রগতিশীল নারী আন্দোলন যার নেতৃত্বে ছিলেন সুফিয়া কামাল ও তার অনুসারী অনেক মহিয়সী নারী। আবার এর পাশাপাশি ঘটেছিল কিছুটা হলেও বাঙালি সাংস্কৃতিক জাগরণ; তাতে সত্যেন সেন থেকে শুরু করে সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রহমান, সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রমূখ ছিলেন অগ্রসেনানী।
স্বাধীনতার চূড়ান্ত লগ্নে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেবার অধিকারী হিসেবে জনগণের নির্বাচিত দল আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন তাজউদ্দিন আহমদই হাতে তুলে নিয়েছিলেন। সে সময়ে দলের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন ছিল ইতিহাসের এক দৃষ্টান্ত।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে দ্রুতই তাঁর ও স্বাধীনতার আন্দোলনের শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তিনি নীরবে সরকার থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন— কিন্তু স্বাধীনতার আদর্শ থেকে সরে দাঁড়াননি।
সরকার থেকে সরে গেলেও ইতিহাস থেকে তাজউদ্দিন আহমদ তো সরে যায় না। তাই তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী বাংলাদেশে পালিত হওয়া উচিত ছিল। তবে এ সত্যও বলতে হয় আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যে খুব ধুমধামে সেটা পালিত হতো তা নয়। কারণ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমনকি ইন্দিরা গান্ধীও অনেকটা উপেক্ষিত ছিলেন। তবে সেটা সম্প্রতি কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক যা বলছে সে কারণে নয়, এটা আমাদের জাতীয় চরিত্র— যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান।”
তাজউদ্দিন আহমদের জন্ম শতবর্ষে এসে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী তাঁর ভাষণের একটি কথা দিয়েই আজ তাকে সর্বোচ্চ স্মরণ করা যেতে পারে, তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি স্বাধীনতার চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হই তাহলে একদিন স্বাধীনতার বিরোধীরা আমাদের ঘর থেকে টেনে বের করে করে হত্যা করবে— মুক্তিযুদ্ধ করা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম করার অপরাধে।