সন্ত্রাসের আঁধারে ঢাকার গুলশান
২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত। রমজানের শেষ প্রান্তে ঈদের প্রস্তুতি যখন পুরোদমে, ঠিক তখনই রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক অঞ্চল গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে শুরু হয় এক ভয়াবহ জিম্মি সংকট। প্রায় রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে অস্ত্রধারী আইএস জঙ্গীরা হঠাৎ হোলি আর্টিজানে ঢুকে পড়ে, গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং দেশি-বিদেশি নাগরিকসহ অতিথিদের জিম্মি করে। তাদের লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক প্রচার পাওয়া, সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি এবং একটি ভয়ঙ্কর বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
ঘটনার প্রাথমিক মুহূর্ত: পুলিশের সীমাবদ্ধতা
সন্ত্রাসীরা প্রথমে রেস্তোরাঁর প্রধান গেট বন্ধ করে ফেলে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের হত্যা করে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর সদস্যরা রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের মুখে দুই পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। অবস্থার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের পক্ষে অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না।
সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপ: শুরু ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’
সন্ত্রাসীরা যখন জিম্মিদের নিয়ে ভেতরে অবস্থান করছিল, তখন রাতভর গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে। পরদিন ২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিট “মার্কোস-অনুপ্রাণিত” মেরিন কমান্ডো বাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামের একটি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান শুরু করে।
অভিযানকাল ও সময়: ১২ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধ অভিযান
‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ কার্যকরভাবে শুরু হয় সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে এবং শেষ হয় সকাল ৭টা ৫২ মিনিটে। মাত্র ১২ মিনিটেই মেরিন কমান্ডোরা অভিযানটি সফলভাবে শেষ করেন। যদিও পুরো প্রস্তুতি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অবস্থান বিশ্লেষণ এবং কৌশল পরিকল্পনায় রাতভর সময় লেগেছে, মূল অভিযানটি ছিল একেবারে দ্রুত ও নিখুঁত।
অভিযানের কৌশল ও রণনীতি
মেরিন কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ছিল আন্তর্জাতিক মানের, যার প্রমাণ তারা হোলি আর্টিজানের অভিযানে প্রদর্শন করেন। তাদের প্রধান কৌশল ছিল—
ফ্ল্যাশব্যাং (আলো ও শব্দ সৃষ্টিকারী বোমা) ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের বিভ্রান্ত করা
দুই দিক থেকে আক্রমণ করে ঘিরে ফেলে সন্ত্রাসীদের বিচ্ছিন্ন করা
স্নাইপার ও ক্লোজ কমব্যাট ইউনিটের সমন্বয়ে ভেতরে প্রবেশ
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জিম্মিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সন্ত্রাসীদের নিষ্ক্রিয় করা এই পুরো কৌশল ছিল সাইলেন্ট ও হাই-প্রিসিশন, যাতে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বা জিম্মিদের ক্ষতি করতে না পারে।
অভিযানের ফলাফল: একটি সফল মিশন, একটি জাতির গর্ব
এই অভিযানে ৫ জন আইএস জঙ্গী নিহত হয়। মোট ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়, যাদের মধ্যে একজন জাপানি, দুজন শ্রীলঙ্কান নাগরিক ছিলেন। তবে, অভিযান শুরু হওয়ার আগেই সন্ত্রাসীরা ২০ জন জিম্মিকে হত্যা করে, যাদের বেশিরভাগই বিদেশি নাগরিক ছিলেন (জাপান, ইতালি, আমেরিকা ও ভারত)। এছাড়াও একজন বাংলাদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান।
মেরিন কমান্ডোদের পেশাদারিত্ব: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
অভিযান শেষে সেনাবাহিনী সংবাদ সম্মেলনে জানায়, মেরিন কমান্ডোরা সর্বোচ্চ সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে অভিযানটি সম্পন্ন করেন। এই অভূতপূর্ব সাফল্য বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসিত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এই অভিযানকে দ্রুততম এবং সবচেয়ে কার্যকর জঙ্গি প্রতিরোধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
কেন ছিল এই অভিযান গুরুত্বপূর্ণ?
এই অভিযান শুধু একটি রেস্তোরাঁ দখলের সমাপ্তি নয়; এটি ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক বার্তা রুখে দেওয়ার এক দৃঢ় অবস্থান। হোলি আর্টিজান বেকারির হামলার পর বাংলাদেশ নিরাপত্তা নীতিতে বড় পরিবর্তন আনে, বিশেষ করে গোয়েন্দা নজরদারি, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও নাগরিক নিরাপত্তা জোরদার করার ক্ষেত্রে।
ইতিহাসে লেখা থাকবে ‘থান্ডারবোল্ট’
হোলি আর্টিজানে মেরিন কমান্ডোদের অভিযান শুধু একটি সফল জঙ্গি প্রতিরোধই নয়, এটি ছিল একটি জাতির আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। মাত্র ১২ মিনিটে দৃঢ়তা, কৌশল ও প্রশিক্ষণের মিশেলে তারা প্রমাণ করেন—বাংলাদেশ নিরাপত্তাহীন নয়, বরং প্রস্তুত। ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ আজও জাতীয় নিরাপত্তার ইতিহাসে একটি গর্বিত অধ্যায় হয়ে আছে।