শুরুর গল্প: একজন হাসির মানুষ
বাংলাদেশের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র জগতে যারা কমেডির ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে হাসমত (আসল নাম: মো. আনোয়ারুল ইসলাম হাসমত) এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি শুধু একজন কৌতুকাভিনেতা ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন জীবনঘনিষ্ঠ গল্পবলিয়ে, যিনি তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছিলেন।
অভিনয়ে আগমন ও প্রথম সাফল্য
হাসমতের অভিনয়ে প্রবেশ ঘটে ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে। ছোটবেলা থেকেই নাট্যচর্চা ছিল তাঁর নেশা। পরিবারে তাঁর চাচা ছিলেন একজন নাট্যকর্মী, যিনি তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিলেন অভিনয়ে যুক্ত হতে। ঢাকায় এসে তিনি নাট্যদল “নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়”-এ যুক্ত হন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন অভিনয় ছিল বিটিভির নাটক “তৃতীয় পক্ষ”, যেখানে এক নম্বর চরিত্র না হলেও হাস্যরসাত্মক ভূমিকায় তিনি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
তবে তাঁর জনপ্রিয়তা এসেছিল বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে “হাসমত আলী” চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। এখান থেকেই তিনি দেশের ঘরে ঘরে ‘হাসমত’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন।
কৌতুকাভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা ও বিশেষ গুণাবলি
হাসমতের অভিনয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তব জীবনের সহজ ও সরল চরিত্রগুলোকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা। তাঁর সংলাপ বলার ধরন, মুখাবয়বের অভিব্যক্তি এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই হালকা ব্যঙ্গরসাত্মক মন্তব্য দর্শকদের মন জয় করত।
তিনি যে কোনো চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলতেন। রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানি, বাজারের হকার—এসব চরিত্রে তিনি এমনভাবে অভিনয় করতেন যেন দর্শক মনে করতেন, এ তো আমাদের পাশের মানুষ!
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণ
হাসমত দেশের বাইরেও তাঁর কৌতুক প্রতিভা নিয়ে গিয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতেন। যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কমিউনিটির আয়োজনে হাস্যরসাত্মক নাটক ও মঞ্চআলোচনায় তিনি অংশ নিয়েছেন। এসব স্থানে তিনি শুধু বিনোদনের মাধ্যমই হননি, বরং হয়ে উঠেছেন সংস্কৃতির দূত।
সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ড
অভিনয়ের বাইরেও হাসমতের জীবনে মানবিকতা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি শিশুর অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন “আপন আলো” নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে নাট্যচর্চা পরিচালনা এবং ভ্রাম্যমাণ নাট্য প্রদর্শনী ছিল তাঁর অন্যতম উদ্যোগ।
তিনি বহুবার অভিনয় থেকে উপার্জনের একটি অংশ বন্যার্তদের সহায়তায় দান করেছেন। করোনা মহামারির সময় নিজ উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করেছেন গ্রামের গরিব শিল্পী ও কর্মহীন মানুষের মাঝে।
পারিবারিক জীবন ও বৈবাহিক সম্পর্ক
হাসমতের স্ত্রীর নাম সালমা পারভীন। তিনি একজন স্কুলশিক্ষিকা ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক। হাসমতের অভিনয়জীবনে তাঁর স্ত্রীর সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য।
তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলেটি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এবং মেয়েটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
হাসমতের দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তিনি পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (২০০৩) – কৌতুকভিত্তিক অভিনয়ের জন্য।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০১০) – মঞ্চ ও টিভিতে অবদানের জন্য।
একুশে টিভি কৌতুকাভিনেতা সম্মাননা (২০১৫) – টেলিভিশন দর্শক জরিপে সেরা হাস্যাভিনেতা।
শেষ জীবন ও বিদায়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাসমত অভিনয়ে কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন। বয়সজনিত অসুস্থতা এবং নাট্যজগতের পেশাগত পরিবর্তন তাঁকে আড়ালে নিয়ে গিয়েছিল। তবে বিভিন্ন টক শো, রিয়েলিটি শো ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিতেন। ২০২৪ সালের শেষ দিকে তিনি একটি আত্মজীবনীমূলক বই লেখার কাজ শুরু করেছিলেন, যার কিছু অংশ ইত্যাদি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল।
২০২৫ সালের শুরুতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং পরে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
উপসংহার: হাসির মানুষটির চিরস্থায়ী ছাপ
হাসমত ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা, যিনি হাস্যরসের আড়ালে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরতেন। তাঁর অভিনয় ছিল বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি কেবল একজন অভিনেতাই নন, ছিলেন একজন মানবিক শিল্পী। হাসির আবরণে তিনি দেশের মানুষকে বারবার ভাবিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বাংলাদেশের কৌতুকাভিনয়ের ইতিহাসে হাসমত একটি অমলিন নাম। তাঁকে স্মরণ করলেই এক ধরনের ঘরোয়া হাসি, মাটির গন্ধ আর হৃদয়ের উষ্ণতা ফিরে আসে। তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁর কাজ, চরিত্র আর হাসির আবেশ আমাদের মাঝে রয়ে যাবে চিরকাল।