লুকিয়ে থাকা জীবনের প্রতিদিন
কাবুলের ২২ বছর বয়সী সিমিন প্রতিটি নতুন গ্রাহকের আগমনকে দেখে আতঙ্কে। তাঁদের বলা হয় কয়েক ব্লক দূরে গাড়ি পার্ক করতে, তালেবান টহল এড়িয়ে আসতে। এরপর তারা নিঃশব্দে এক দরজায় এসে কড়া নাড়ে।
সেই দরজার আড়ালেই চলছে সিমিনের গোপন বিউটি পার্লার। এক সময় এই ব্যবসাই ছিল তার পরিবারের প্রধান আয়। কিন্তু ২০২৩ সালে তালেবান সরকার “ইসলামে নিষিদ্ধ” অপকর্মের অভিযোগে বিউটি পার্লার নিষিদ্ধ করে দেয়। সিমিন বললেন, “তালেবান যদি আমাদের খুঁজে পায়, ভয় পাই। কিন্তু এই কাজ ছাড়া পরিবারের কোনো আয় নেই।”
স্কুল শেষে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সিমিন। কিন্তু ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান ফিরে আসলে নারীদের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়—ষষ্ঠ শ্রেণির পর শিক্ষা নিষিদ্ধ, সরকারি দফতরে কাজ নিষিদ্ধ, পোশাক ও চলাফেরায় কঠোরতা, “নৈতিকতা পুলিশ” দ্বারা নজরদারি।
প্রথমদিকে ১২,০০০ বিউটি পার্লার নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিল। সিমিন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পার্লার খুলেছিলেন। আফগান কনে ও তাদের পরিবার সাজসজ্জার জন্য ভিড় করত। তার উপার্জনে পুরো পরিবার চলত, এমনকি বেকার বাবা ও ভাইও।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর শাস্তি
কিন্তু ২০২৩ সালের মাঝামাঝি তালেবান ঘোষণা দেয় সব পার্লার বন্ধ করতে হবে। এক ভিডিওতে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ভ্রু প্লাকিং, প্রসাধনী ও কৃত্রিম চুল ব্যবহার শরিয়াহ অনুযায়ী বৈধ নয়। বিয়ের সাজসজ্জা বরপক্ষের জন্য “অর্থনৈতিক বোঝা”।
তালেবান কর্তৃপক্ষ এখনো সুনির্দিষ্ট শাস্তির ঘোষণা না দিলেও, জাতিসংঘ জানায় ২০২৩ সালে অনেক পার্লার মালিককে আটক করা হয়েছিল।
ছায়ার মধ্যে নারীদের সংগ্রাম
তালেবান শাসনে নারীরা প্রায় সব উচ্চ পদ ও ভালো চাকরি থেকে ছিটকে পড়েছে। তারা এখন কম মজুরির, অদক্ষ বা গোপন কাজের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির চার দশকের যুদ্ধের ফলে অনেক পুরুষ মৃত বা অক্ষম, ফলে নারীরাই পরিবার চালাচ্ছে।
৩০ বছর বয়সী সাবিতা নিজের পঙ্গু মা ও পাঁচ ভাইবোনকে একাই দেখভাল করেন। তার বাবা ৮ বছর আগে তালেবানের আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন। তিনি পার্লার চালানো বন্ধ করে এখন কাবুলের এক বেসমেন্টে চামড়ার ব্যাগ তৈরি শেখান। কিন্তু উপার্জন এতই কম যে পরিবারকে এক কক্ষের ছোট বাসায় থাকতে হচ্ছে।
সাবিতা বললেন, “আমি সবচেয়ে বেশি মিস করি সকালবেলা কোরআন পড়ে কাজে যাওয়া—এটাই ছিল আমার স্বাধীনতা।”
তালেবানের নতুন “নারীবান্ধব” প্রচার
তালেবান স্পষ্ট করেই বলেছে তারা নারীদের কর্মজীবন থেকে সরাতে চায়। ২০২৩ সালে উপ-শ্রমমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “৯৫ শতাংশ আফগান পুরুষ নারীদের কাজে যেতে চায় না।” তবে এখন সরকার বলছে, নারীরা “নারীদের জন্য নির্ধারিত” খাতে কাজ করতে পারবে—যেমন নারী স্কুল, হাসপাতাল, কারাগার বা নারী বাজারে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সামিউল্লাহ ইব্রাহিমি দাবি করেন, “নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।” উদ্যোক্তা ফারিবা নুরি বললেন, “তালেবান আমাদের কাজ করতে বলছে, সহায়তা করছে।”
তবুও হাজারো বাধা
কিন্তু বাস্তবে নারীরা এখনো কঠিন বাধার মুখে। কাজ পেতে তাদের সঙ্গী পুরুষ অভিভাবক প্রয়োজন, নৈতিকতা পুলিশ হঠাৎ হানা দেয়, নিয়মগুলো অনির্দিষ্ট ও কঠোর। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান নারীদের নিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে।
পারওয়ান প্রদেশে এক রেডিও স্টেশনে কাজ করা ২৪ বছর বয়সী নারী বললেন, পুলিশ অফিসে হানা দিলে সহকর্মীরা তাঁকে লুকিয়ে রাখে। পরে চাকরি ছেড়ে দেন। এখন প্রতিদিন ইমেইলে চাকরির সাক্ষাৎকারের অপেক্ষায় থাকেন।
শেষ ভরসা: অনলাইন ব্যবসা
২৩ বছর বয়সী বেহেশ্তা ২০২৩ সালের অক্টোবরে অনলাইনে প্রসাধনী ও গয়না বিক্রি শুরু করলে ভালো সাড়া পান। অনেকে নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে তাঁর পরামর্শ চান। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বিদেশি অনুদান কমে যাওয়ায় নারী পরিচালিত স্টার্টআপগুলোও ধাক্কা খাচ্ছে।
বেহেশ্তা বলেন, “আগে ভাবতাম দোষ আমার। পরে বুঝলাম—সবাই একই সমস্যায়।”
ফারিবা নুরি বলেন, “নারীদের স্বনির্ভর করার জন্য আমরা অনুদানের আবেদন করেছি, কিন্তু প্রায় সব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।”
আশার শেষ রশ্মি
সিমিন এখন বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বললেন, “আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই, স্বপ্নপূরণ করতে চাই।”