০৪:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

ইউরোপের তিন তরুণীর চোখে আইএস: সিরিয়া থেকে ফিরে আসার পর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্বীকারোক্তি

পশ্চিমা সমাজ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে

গত এক দশকে পশ্চিমা ইউরোপের বহু তরুণী আইএসের দৃষ্টিনন্দন প্রচারণার ফাঁদে পড়ে সিরিয়া ও ইরাকে গেছে “খিলাফতের জীবন” গড়তে। কেউ প্রেমিকের হাত ধরে, কেউ মানবিক সহায়তার নাম করে, কেউ আবার সামাজিক বঞ্চনা ও পরিচয় সংকট থেকে মুক্তির খোঁজে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভয়ানক: সহিংসতা, নিপীড়ন, ক্ষুধা ও বন্দিত্ব।

এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করছি তিন ইউরোপীয় নারীর—শামিমা বেগম (যুক্তরাজ্য), সোফি কাসিকি (ফ্রান্স) ও মার্লিন নিভারলাইন (সুইডেন)—যারা আইএসে যোগ দিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন এবং গণমাধ্যমে সরাসরি সেই অভিজ্ঞতা স্বীকার করেছেন।

শামিমা বেগম (যুক্তরাজ্য): নাগরিকত্ব হারানো কিশোরীর কাহিনি

২০১৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে লন্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির ছাত্রী শামিমা বেগম দুই বান্ধবীসহ তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় পৌঁছেন। সেখানে রাক্কায় এক আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেন। পরবর্তী কয়েক বছরে তিন সন্তানের জন্ম দেন, যাদের সবাই অনাহার বা রোগে মারা যায়।

২০১৯ সালে The Times–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:

“আমি কখনোই কোনো সহিংস কাজে যুক্ত ছিলাম না। কোনো প্রচারণা করিনি। কাউকে সিরিয়ায় আসার আহ্বান করিনি। আমি শুধু শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলাম।”

তবে এই স্বীকারোক্তি বিতর্ক সৃষ্টি করে, কারণ অনেকেই মনে করেন তিনি মূলত দায় এড়ানোর জন্য অনুতপ্ত হওয়ার অভিনয় করছেন। BBC ও The Sun–এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিনি আল-হল শিবিরে আবেগহীন, অন্য বন্দীদের সঙ্গে ক্ষমতার খেলা খেলেন এবং ক্যামেরার সামনে নিজেকে নিরীহ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

যুক্তরাজ্য সরকার ২০১৯ সালে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আবেদন খারিজ করে। ফলে তিনি সিরিয়ার বন্দিশিবিরেই আটকে থাকেন।

সোফি কাসিকি (ফ্রান্স): সাহায্যের নামে ফাঁদে পড়া এক মা

২০১৪ সালে ফরাসি নাগরিক সোফি কাসিকি, ছদ্মনামে পরিচিত, আইএসের প্রচারণায় বিশ্বাস করে তাঁর চার বছরের সন্তানকে নিয়ে রাক্কায় যান। তাঁর ধারণা ছিল তিনি একটি হাসপাতালে কাজ করবেন এবং মানবিক সহায়তা দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তাকে বন্দি করে রাখা হয় অন্য বিদেশি নারীদের সঙ্গে। তাদের জন্য বিনোদনের উপায় ছিল শিরোচ্ছেদের ভিডিও দেখা।

Dans la nuit de Daech নামক স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন:

“তাদের কাছে নারী শুধু সন্তান জন্মদানের যন্ত্র। তারা আমাদের বেঁধে রাখত, চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার মানবিক শর্তগুলোও পূরণ করত না।”

স্থানীয় এক পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে পালাতে সাহায্য করে। তুরস্ক সীমান্ত পেরিয়ে তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন। পরে তাঁকে দুই মাস কারাগারে রাখা হয় এবং রাষ্ট্রীয় তদন্তের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি গণমাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলেন—আইএস একটি বর্বর, লিঙ্গবাদী ও শোষণমুখী সংগঠন।

মার্লিন নিভারলাইন (সুইডেন): প্রেমিকের হাত ধরে বিভীষিকায়

মাত্র ১৫ বছর বয়সী সুইডিশ কিশোরী মার্লিন নিভারলাইন ২০১৫ সালে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার মসুলে পৌঁছান। তাঁর ধারণা ছিল আইএস শান্তিপূর্ণ একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ছে। কিন্তু বাস্তবে তার দিন কাটে নির্জনতা, অনাহার ও আতঙ্কে।

এক কুর্দি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:

“আমি জানতাম না আইএস কী। আমি শুধু প্রেমিকের কথায় হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি—না পানি, না বিদ্যুৎ, না খাবার। শুধু ভয় আর অনিশ্চয়তা।”

শেষ পর্যন্ত তিনি মাকে ফোন করেন। কুর্দি বাহিনী তাঁকে উদ্ধার করে এবং সুইডেনে ফিরিয়ে দেয়। তিনি এখন পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় রয়েছেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে কিশোর-তরুণদের সতর্ক করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক উদ্যোগে যুক্ত রয়েছেন।

মিল ও পার্থক্য: অভিন্ন প্রেক্ষাপটভিন্ন পরিণতি

বিষয় শামিমা বেগম (UK) সোফি কাসিকি (France) মার্লিন নিভারলাইন (Sweden)
বয়স ১৫ ৩৩ ১৫
কিভাবে যোগ দেন অনলাইন প্রচারণা হাসপাতালে কাজের প্রতিশ্রুতি প্রেমিকের প্ররোচনায়
শারীরিক অবস্থা ৩ সন্তান মৃত শিশু নিয়ে ফিরে বেঁচে ফিরে এসেছেন
বন্দিত্ব আল-হল শিবির বিদেশি নারী শিবির কুর্দিদের কাছে আটক
ফিরে আসা ফেরার অনুমতি নেই তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে ফেরা কুর্দিরা উদ্ধার করে
গণমাধ্যমে স্বীকারোক্তি The Times, BBC, Sun স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার টিভি সাক্ষাৎকার
সরকারের পদক্ষেপ নাগরিকত্ব বাতিল জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত পুনর্বাসন

বয়ঃসন্ধির ফাঁদ ও রাজনৈতিক দ্বিধা

এই তিন নারীর অভিজ্ঞতা একটিই বিষয় স্পষ্ট করে—আইএস কেবল ধর্মীয় কট্টরপন্থার সংগঠন নয়, এটি ছিল একধরনের সাংস্কৃতিক নিপীড়নের যন্ত্র, যা বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের ওপর প্রয়োগ হয়েছে। প্রেম, মানবিক সহায়তা বা পরিচয়ের সন্ধান—এই তিনটি মাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠনটি পশ্চিমা তরুণীদের ফাঁদে ফেলেছে।

তাদের স্বীকারোক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কীভাবে তথ্য বিকৃতি, পরিচয়ের সংকট, এবং কল্পিত সমাজভূমির লোভে তরুণীরা জড়িয়ে পড়ে এক অন্ধকার জীবনে, এবং সেই জীবন থেকে ফিরে আসতে কী ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হয়—তা এই কাহিনিগুলোয় ফুটে উঠেছে।

ইউরোপের তিন তরুণীর চোখে আইএস: সিরিয়া থেকে ফিরে আসার পর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্বীকারোক্তি

০৫:৩০:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

পশ্চিমা সমাজ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে

গত এক দশকে পশ্চিমা ইউরোপের বহু তরুণী আইএসের দৃষ্টিনন্দন প্রচারণার ফাঁদে পড়ে সিরিয়া ও ইরাকে গেছে “খিলাফতের জীবন” গড়তে। কেউ প্রেমিকের হাত ধরে, কেউ মানবিক সহায়তার নাম করে, কেউ আবার সামাজিক বঞ্চনা ও পরিচয় সংকট থেকে মুক্তির খোঁজে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভয়ানক: সহিংসতা, নিপীড়ন, ক্ষুধা ও বন্দিত্ব।

এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করছি তিন ইউরোপীয় নারীর—শামিমা বেগম (যুক্তরাজ্য), সোফি কাসিকি (ফ্রান্স) ও মার্লিন নিভারলাইন (সুইডেন)—যারা আইএসে যোগ দিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন এবং গণমাধ্যমে সরাসরি সেই অভিজ্ঞতা স্বীকার করেছেন।

শামিমা বেগম (যুক্তরাজ্য): নাগরিকত্ব হারানো কিশোরীর কাহিনি

২০১৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে লন্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমির ছাত্রী শামিমা বেগম দুই বান্ধবীসহ তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় পৌঁছেন। সেখানে রাক্কায় এক আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেন। পরবর্তী কয়েক বছরে তিন সন্তানের জন্ম দেন, যাদের সবাই অনাহার বা রোগে মারা যায়।

২০১৯ সালে The Times–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:

“আমি কখনোই কোনো সহিংস কাজে যুক্ত ছিলাম না। কোনো প্রচারণা করিনি। কাউকে সিরিয়ায় আসার আহ্বান করিনি। আমি শুধু শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলাম।”

তবে এই স্বীকারোক্তি বিতর্ক সৃষ্টি করে, কারণ অনেকেই মনে করেন তিনি মূলত দায় এড়ানোর জন্য অনুতপ্ত হওয়ার অভিনয় করছেন। BBC ও The Sun–এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিনি আল-হল শিবিরে আবেগহীন, অন্য বন্দীদের সঙ্গে ক্ষমতার খেলা খেলেন এবং ক্যামেরার সামনে নিজেকে নিরীহ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

যুক্তরাজ্য সরকার ২০১৯ সালে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আবেদন খারিজ করে। ফলে তিনি সিরিয়ার বন্দিশিবিরেই আটকে থাকেন।

সোফি কাসিকি (ফ্রান্স): সাহায্যের নামে ফাঁদে পড়া এক মা

২০১৪ সালে ফরাসি নাগরিক সোফি কাসিকি, ছদ্মনামে পরিচিত, আইএসের প্রচারণায় বিশ্বাস করে তাঁর চার বছরের সন্তানকে নিয়ে রাক্কায় যান। তাঁর ধারণা ছিল তিনি একটি হাসপাতালে কাজ করবেন এবং মানবিক সহায়তা দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তাকে বন্দি করে রাখা হয় অন্য বিদেশি নারীদের সঙ্গে। তাদের জন্য বিনোদনের উপায় ছিল শিরোচ্ছেদের ভিডিও দেখা।

Dans la nuit de Daech নামক স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন:

“তাদের কাছে নারী শুধু সন্তান জন্মদানের যন্ত্র। তারা আমাদের বেঁধে রাখত, চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার মানবিক শর্তগুলোও পূরণ করত না।”

স্থানীয় এক পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে পালাতে সাহায্য করে। তুরস্ক সীমান্ত পেরিয়ে তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন। পরে তাঁকে দুই মাস কারাগারে রাখা হয় এবং রাষ্ট্রীয় তদন্তের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি গণমাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলেন—আইএস একটি বর্বর, লিঙ্গবাদী ও শোষণমুখী সংগঠন।

মার্লিন নিভারলাইন (সুইডেন): প্রেমিকের হাত ধরে বিভীষিকায়

মাত্র ১৫ বছর বয়সী সুইডিশ কিশোরী মার্লিন নিভারলাইন ২০১৫ সালে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার মসুলে পৌঁছান। তাঁর ধারণা ছিল আইএস শান্তিপূর্ণ একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ছে। কিন্তু বাস্তবে তার দিন কাটে নির্জনতা, অনাহার ও আতঙ্কে।

এক কুর্দি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:

“আমি জানতাম না আইএস কী। আমি শুধু প্রেমিকের কথায় হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি—না পানি, না বিদ্যুৎ, না খাবার। শুধু ভয় আর অনিশ্চয়তা।”

শেষ পর্যন্ত তিনি মাকে ফোন করেন। কুর্দি বাহিনী তাঁকে উদ্ধার করে এবং সুইডেনে ফিরিয়ে দেয়। তিনি এখন পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় রয়েছেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে কিশোর-তরুণদের সতর্ক করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক উদ্যোগে যুক্ত রয়েছেন।

মিল ও পার্থক্য: অভিন্ন প্রেক্ষাপটভিন্ন পরিণতি

বিষয় শামিমা বেগম (UK) সোফি কাসিকি (France) মার্লিন নিভারলাইন (Sweden)
বয়স ১৫ ৩৩ ১৫
কিভাবে যোগ দেন অনলাইন প্রচারণা হাসপাতালে কাজের প্রতিশ্রুতি প্রেমিকের প্ররোচনায়
শারীরিক অবস্থা ৩ সন্তান মৃত শিশু নিয়ে ফিরে বেঁচে ফিরে এসেছেন
বন্দিত্ব আল-হল শিবির বিদেশি নারী শিবির কুর্দিদের কাছে আটক
ফিরে আসা ফেরার অনুমতি নেই তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে ফেরা কুর্দিরা উদ্ধার করে
গণমাধ্যমে স্বীকারোক্তি The Times, BBC, Sun স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার টিভি সাক্ষাৎকার
সরকারের পদক্ষেপ নাগরিকত্ব বাতিল জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত পুনর্বাসন

বয়ঃসন্ধির ফাঁদ ও রাজনৈতিক দ্বিধা

এই তিন নারীর অভিজ্ঞতা একটিই বিষয় স্পষ্ট করে—আইএস কেবল ধর্মীয় কট্টরপন্থার সংগঠন নয়, এটি ছিল একধরনের সাংস্কৃতিক নিপীড়নের যন্ত্র, যা বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের ওপর প্রয়োগ হয়েছে। প্রেম, মানবিক সহায়তা বা পরিচয়ের সন্ধান—এই তিনটি মাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠনটি পশ্চিমা তরুণীদের ফাঁদে ফেলেছে।

তাদের স্বীকারোক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কীভাবে তথ্য বিকৃতি, পরিচয়ের সংকট, এবং কল্পিত সমাজভূমির লোভে তরুণীরা জড়িয়ে পড়ে এক অন্ধকার জীবনে, এবং সেই জীবন থেকে ফিরে আসতে কী ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হয়—তা এই কাহিনিগুলোয় ফুটে উঠেছে।