০৫:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

মিয়ানমারের প্রতারণা চক্রের ভরসা এখন স্টারলিংক

মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষা এলাকায় গড়ে ওঠা প্রতারণা কেন্দ্রগুলো কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে। থাইল্যান্ডে ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ কেটে দেওয়ার পর এসব চক্র ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে — নতুন উপাত্তে এমনটাই ইঙ্গিত মিলেছে।

থাইল্যান্ডের সংযোগ ছাঁটাই

মে ২০২৪ সালে থাই টেলিকম কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে যাচ্ছে এমন সিগন্যাল ও কেবল বন্ধ করে দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তবর্তী প্রতারণা কম্পাউন্ডগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা।

স্টারলিংকে ঝুঁকে প্রতারণা চক্র

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (আইজেএম) জানিয়েছে, এই কাটা-ছেঁড়ার পর থেকেই কম্পাউন্ডগুলো স্টারলিংকের ব্যবহার দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়েছে। আইজেএমের বৈশ্বিক বিশ্লেষক এরিক হেইন্টজ বলেন, কেকে পার্কসহ বড় কম্পাউন্ডগুলোতে বৃদ্ধি স্পষ্ট — গুগলের স্যাটেলাইট ছবিতেও ছাদজুড়ে ছোট সাদা আয়তাকার অ্যান্টেনা দেখা যাচ্ছে।

ডেটা কী বলছে

মিয়ানমারের মায়াওয়াড্ডি টাউনশিপের আশপাশের আটটি বড় কম্পাউন্ড থেকে সংগৃহীত মোবাইল ফোন ডেটা বিশ্লেষণ করে আইজেএম দেখেছে, এপ্রিল ২০২৫ সালে স্টারলিংক সংযোগ ছিল ২,৪৯২টি — এপ্রিল ২০২৪ সালের তুলনায় যা দ্বিগুণেরও বেশি। আইজেএম স্বীকার করেছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বড় হতে পারে।

ছোট অ্যান্টেনা, সহজ পাচার

স্টারলিংকের ডিশের মাপ প্রায় ৪০ বাই ৬০ সেন্টিমিটার — ব্যাকপ্যাকে ভরে সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে পাচার করা যায়। ডিশ, রাউটার আর কয়েকটি কেবল থাকলেই সেবা নেওয়া সম্ভব, যদি পাশের কোনো দেশে স্টারলিংক অনুমোদিত থাকে। মিয়ানমারে অনুমোদন না থাকলেও কম্পাউন্ডগুলো এটিকে স্যাটেলাইটভিত্তিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন হার্ভার্ড এশিয়া সেন্টারের গবেষক জ্যাকব সিমস।

সীমান্তের ওপার থেকে দেখা বাড়তি ডিশ

থাই সীমান্ত শহর মায়ে সট-এ অবস্থিত এনজিও গ্লোবাল আলমসের প্রধান মিশেল মুর জানান, ২০২৩ সাল থেকেই ডিশ বসানো শুরু হয়েছিল — থাইল্যান্ডের আগের এক দফা সংযোগ বিচ্ছিন্নের চেষ্টার পর। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি কম্পাউন্ডের ছাদ ও বারান্দা ডিশে ঢেকে গেছে। তাঁর ভাষায়, “এটাই এখন তাদের নতুন পথ।”

‘তিন কাটা’ অভিযান ও এর ফল

থাই কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট-ফোন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ — এই তিনটি সরবরাহ বন্ধ করাকে ‘তিন কাটা’ বলে সফলতা দাবি করছে। সরকারের হিসাব, জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে থাই নাগরিকদের প্রতারণার শিকার হওয়ার অভিযোগ ২০ শতাংশ কমেছে। রয়্যাল থাই পুলিশের জেনারেল থানচাই পিতানীলাবুত জানান, ভারত, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকেও কল কমার খবর এসেছে। তবে পরিমাণগত তথ্য তাঁর হাতে নেই, এবং তিনি স্বীকার করেন — এখনও প্রায় ১ লাখ মানুষ এসব কম্পাউন্ডে কাজ করছে।

প্রধান বাধা: পাচার থামানো যায়নি

থানচাই বলেন, জ্বালানি ও স্টারলিংকের যন্ত্রাংশ সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়ায় ‘তিন কাটা’র প্রভাব কমে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড বিদেশি সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে স্টারলিংককে সীমান্ত এলাকায় সেবা বন্ধ করতে বলেছে, তবে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তিনি। তাঁর মন্তব্য, “স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ না হলে পুরোপুরি থামানো কঠিন।”

থাইল্যান্ডের জোরালো পদক্ষেপ কিছুটা ফল দিচ্ছে, কিন্তু স্যাটেলাইটভিত্তিক সংযোগ ও সীমান্তপাচার এই ‘তিন কাটা’ কৌশলকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। আইজেএমের ডেটা ও মাঠের পর্যবেক্ষণ বলছে — প্রতারণা চক্রগুলো দ্রুত অভিযোজন করছে। আন্তর্জাতিক সমন্বয় ছাড়া স্টারলিংকের মতো প্রযুক্তিভিত্তিক বিকল্প পথ বন্ধ করা কঠিনই থেকে যাবে।

প্রযুক্তির কাটছাঁটে সরকারগুলো যতই এগিয়ে আসুক, সীমান্ত পেরোনো স্যাটেলাইট সিগন্যাল এবং সহজে বহনযোগ্য ডিশের যুগে প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই হবে আরও কৌশলী ও দীর্ঘমেয়াদি। এখানে মানবপাচার, শ্রম শোষণ ও আর্থিক প্রতারণা — সবকিছু মোকাবিলায় দরকার সমন্বিত আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দ্রুত সাড়া।

মিয়ানমারের প্রতারণা চক্রের ভরসা এখন স্টারলিংক

১১:০০:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষা এলাকায় গড়ে ওঠা প্রতারণা কেন্দ্রগুলো কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে। থাইল্যান্ডে ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ কেটে দেওয়ার পর এসব চক্র ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে — নতুন উপাত্তে এমনটাই ইঙ্গিত মিলেছে।

থাইল্যান্ডের সংযোগ ছাঁটাই

মে ২০২৪ সালে থাই টেলিকম কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে যাচ্ছে এমন সিগন্যাল ও কেবল বন্ধ করে দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তবর্তী প্রতারণা কম্পাউন্ডগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা।

স্টারলিংকে ঝুঁকে প্রতারণা চক্র

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (আইজেএম) জানিয়েছে, এই কাটা-ছেঁড়ার পর থেকেই কম্পাউন্ডগুলো স্টারলিংকের ব্যবহার দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়েছে। আইজেএমের বৈশ্বিক বিশ্লেষক এরিক হেইন্টজ বলেন, কেকে পার্কসহ বড় কম্পাউন্ডগুলোতে বৃদ্ধি স্পষ্ট — গুগলের স্যাটেলাইট ছবিতেও ছাদজুড়ে ছোট সাদা আয়তাকার অ্যান্টেনা দেখা যাচ্ছে।

ডেটা কী বলছে

মিয়ানমারের মায়াওয়াড্ডি টাউনশিপের আশপাশের আটটি বড় কম্পাউন্ড থেকে সংগৃহীত মোবাইল ফোন ডেটা বিশ্লেষণ করে আইজেএম দেখেছে, এপ্রিল ২০২৫ সালে স্টারলিংক সংযোগ ছিল ২,৪৯২টি — এপ্রিল ২০২৪ সালের তুলনায় যা দ্বিগুণেরও বেশি। আইজেএম স্বীকার করেছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বড় হতে পারে।

ছোট অ্যান্টেনা, সহজ পাচার

স্টারলিংকের ডিশের মাপ প্রায় ৪০ বাই ৬০ সেন্টিমিটার — ব্যাকপ্যাকে ভরে সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে পাচার করা যায়। ডিশ, রাউটার আর কয়েকটি কেবল থাকলেই সেবা নেওয়া সম্ভব, যদি পাশের কোনো দেশে স্টারলিংক অনুমোদিত থাকে। মিয়ানমারে অনুমোদন না থাকলেও কম্পাউন্ডগুলো এটিকে স্যাটেলাইটভিত্তিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন হার্ভার্ড এশিয়া সেন্টারের গবেষক জ্যাকব সিমস।

সীমান্তের ওপার থেকে দেখা বাড়তি ডিশ

থাই সীমান্ত শহর মায়ে সট-এ অবস্থিত এনজিও গ্লোবাল আলমসের প্রধান মিশেল মুর জানান, ২০২৩ সাল থেকেই ডিশ বসানো শুরু হয়েছিল — থাইল্যান্ডের আগের এক দফা সংযোগ বিচ্ছিন্নের চেষ্টার পর। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি কম্পাউন্ডের ছাদ ও বারান্দা ডিশে ঢেকে গেছে। তাঁর ভাষায়, “এটাই এখন তাদের নতুন পথ।”

‘তিন কাটা’ অভিযান ও এর ফল

থাই কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট-ফোন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ — এই তিনটি সরবরাহ বন্ধ করাকে ‘তিন কাটা’ বলে সফলতা দাবি করছে। সরকারের হিসাব, জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে থাই নাগরিকদের প্রতারণার শিকার হওয়ার অভিযোগ ২০ শতাংশ কমেছে। রয়্যাল থাই পুলিশের জেনারেল থানচাই পিতানীলাবুত জানান, ভারত, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকেও কল কমার খবর এসেছে। তবে পরিমাণগত তথ্য তাঁর হাতে নেই, এবং তিনি স্বীকার করেন — এখনও প্রায় ১ লাখ মানুষ এসব কম্পাউন্ডে কাজ করছে।

প্রধান বাধা: পাচার থামানো যায়নি

থানচাই বলেন, জ্বালানি ও স্টারলিংকের যন্ত্রাংশ সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়ায় ‘তিন কাটা’র প্রভাব কমে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড বিদেশি সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে স্টারলিংককে সীমান্ত এলাকায় সেবা বন্ধ করতে বলেছে, তবে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তিনি। তাঁর মন্তব্য, “স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ না হলে পুরোপুরি থামানো কঠিন।”

থাইল্যান্ডের জোরালো পদক্ষেপ কিছুটা ফল দিচ্ছে, কিন্তু স্যাটেলাইটভিত্তিক সংযোগ ও সীমান্তপাচার এই ‘তিন কাটা’ কৌশলকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। আইজেএমের ডেটা ও মাঠের পর্যবেক্ষণ বলছে — প্রতারণা চক্রগুলো দ্রুত অভিযোজন করছে। আন্তর্জাতিক সমন্বয় ছাড়া স্টারলিংকের মতো প্রযুক্তিভিত্তিক বিকল্প পথ বন্ধ করা কঠিনই থেকে যাবে।

প্রযুক্তির কাটছাঁটে সরকারগুলো যতই এগিয়ে আসুক, সীমান্ত পেরোনো স্যাটেলাইট সিগন্যাল এবং সহজে বহনযোগ্য ডিশের যুগে প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই হবে আরও কৌশলী ও দীর্ঘমেয়াদি। এখানে মানবপাচার, শ্রম শোষণ ও আর্থিক প্রতারণা — সবকিছু মোকাবিলায় দরকার সমন্বিত আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দ্রুত সাড়া।