শ্রী লেস্তারি ছিলেন জাভার স্রিটেক্স টেক্সটাইল কারখানার ১০,০০০ ছাঁটাইকৃত শ্রমিকের একজন। টানা ২৪ বছর কারখানায় কাটিয়ে এখন তিনি ঝাল মুরগির দোকান চালান।
দশ বছর ধরে রুদি হেনদ্রি জাকার্তার বিশাল তানাহ আবাং বাজারে স্থানীয় তৈরি পোশাক বিক্রি করতেন। তিন বছর আগে এক চীনা ব্যবসায়ী ও তাঁর দোভাষী একটি প্রস্তাব নিয়ে এসে সবকিছু পাল্টে দেন।
তাঁরা চীনা কারখানায় তৈরি ক্রীড়া‑পোশাকের নমুনা আনেন—দাম সস্তা, মানও ভালো। ৫৫ বছর বয়সি রুদি ‘না’ বলতে পারেননি। এখন তাঁর তিনটি স্টল ও একাধিক চীনা কারখানার সঙ্গে অংশীদারিত্ব রয়েছে।
“গুণমান ভালো, দাম ঠিক থাকলে আমি সেটাই নেব,” তানাহ আবাংয়ে দাঁড়িয়ে বলেন তিনি। পাশেই তাঁর কর্মীরা চীনা পোশাকের স্তূপ খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চাকরি ধ্বংস করছে—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন অভিযোগ করলে ইন্দোনেশিয়ায় তা সাড়া ফেলে। আসলে ক্ষতি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ারই; এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটি চীনের অতিপ্রভাব সামলাচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ান ফাইবার অ্যান্ড ফিলামেন্ট ইয়ার্ন প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাদমা গীতা ভিরাওয়াস্ত বলেন, “সবচেয়ে খারাপ বিষয় রপ্তানি আটকানো নয়; বরং আরও বেশি চীনা পণ্য ইন্দোনেশিয়ায় ঢুকে পড়া।”
গত দুই বছরে তৈরি‑পোশাক শিল্প এই চাপ সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছে। সস্তা চীনা পোশাকে বাজার ভরে গেছে, স্থানীয় কারখানা ও মিল একে একে বন্ধ হচ্ছে। রাদমার হিসাবে ২০২৩ সাল থেকে কর্মহীন হয়েছেন তিন লাখ মানুষ।
রুদির পাশের স্টলে সামুয়েল লি (৪৮) এখন মাসে ৪,০০০ ডলার রোজগার করতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন—আগের অর্ধেকেরও কম। গ্রাহকেরা বছর তিনেক আগে থেকেই জানান, চীন থেকে কেনাই সস্তা। “গুণমানে আমরা টিকতে পারছি না,” বলেন তিনি।
চাপ এতটাই বেড়েছে যে আগের প্রেসিডেন্ট চীনা পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্কের হুমকি দিয়েছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তো চীনা কাপড়বাহী চোরাকারবারি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন।
এ সময়েই চীনের রপ্তানি বেড়েছে। দেশের ভেতরে চাহিদা দুর্বল থাকায় এবং সরকারি প্রণোদনায় চীনা কারখানাগুলো দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়ায় ঝুঁকেছে; ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা একাই ২৮৪ মিলিয়ন। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সংকুচিত হওয়ার পর এ প্রবাহ আরও বেড়েছে।
গত মাসে দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়ায় চীনা রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১৭.৫ শতাংশ বেড়েছে। এপ্রিল মাসে ইন্দোনেশিয়ার চীনা পণ্যের আমদানি ৫১ শতাংশ লাফিয়েছে।
চীনের এই রপ্তানি প্রবাহ ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করেছে; তাঁর অভিযোগ, চীন উচ্চ শুল্ক এড়াতে পণ্য অন্য দেশে ঘুরিয়ে পাঠাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া–যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্দোনেশীয় পণ্যের ওপর ১৯ শতাংশ শুল্ক ধার্য হয়েছে; অন্য দেশের হয়ে ঘুরে এলে শুল্ক আরও বেশি। তবে নমুরার অর্থনীতিবিদ ইউবেন পারাকুয়েলসের মতে, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ ইন্দোনেশিয়ায় ভিয়েতনামের মতো বড় বিষয় নয়—চীনা পণ্য কিনছে মূলত ইন্দোনেশিয়ার ভোক্তারাই।
তিনি বলেন, “এগুলো যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে এমন নয়।”
চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক বাড়ানোই সমাধান নয়। অবকাঠামো নির্মাণে চীনা বিনিয়োগে ইন্দোনেশিয়া নির্ভরশীল; পাম অয়েল ও কয়লার মতো সম্পদের সবচেয়ে বড় ক্রেতাও চীন। তবু বিশাল ভর্তুকি‑ভিত্তিক উৎপাদনক্ষমতার জন্য বাণিজ্যে ইন্দোনেশিয়াই প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক হিসাবে, চীনের প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমলে ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি ০.৩ শতাংশ কমে।
২০০০‑এর দশকের গোড়ায় আসিয়ান‑চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পর ইন্দোনেশিয়া প্রায় সব শুল্ক‑প্রতিবন্ধকতা তুলে নিয়েছে। “এ কারণেই চীন আসিয়ানকে রপ্তানি‑বৈচিত্র্যের বাজার মনে করে,” বলেন পারাকুয়েলস।
চীনের সহায়তায় নির্মিত হাই‑স্পিড ট্রেন ‘হুয়ুশ’ জাকার্তা থেকে সবুজ গ্রামাঞ্চল ছুঁয়ে বন্ধুংয়ে ছুটে যায়। বসার আসন থেকে সাইনেজ—সবই চীনা রেলগাড়ির মতো।
বন্ধুং শহরতলির বাজারে এখন চীনা কাপড়ই দাপট দেখায়; স্থানীয় কাপড় টিকে আছে মূলত বাতিকে। স্টলে টকটকে কাপড় বিক্রি করা ২৫ বছর বয়সি এরিক কুর্নিয়াওয়ান বলেন, ২০২১ সালের আগে আশপাশের কারখানার উদ্বৃত্ত কাপড়ই বেশি বিক্রি হতো; এখন চীনা আমদানিই প্রাধান্য পেয়েছে।
৭৩ বছর বয়সি লি জিয়ালুন স্মরণ করেন, সত্তরের শেষভাগে বন্ধুংয়ে জিন্স কারখানা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতেন। এখন তিনি রেস্তোরাঁ ‘ইয়া সিউ’ চালান। বন্ধুরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন—চীনের সঙ্গে পারেননি।
লি বলেন, “কারখানা একা দাঁড়ায় না; আছে অসংখ্য সরবরাহকারী। সবার ওপরই প্রভাব পড়েছে। আমরা আর চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছি না।” তাঁর রেস্তোরাঁর তিন‑চতুর্থাংশ ক্রেতাই চীনা; কোভিডের সময় চীনা শ্রমিকেরা এখানে মিলিত হতেন।
বন্ধুং থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে সোলো শহরে, চলতি বছরের মার্চে দেশের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল কারখানা স্রিটেক্স বন্ধ হয়ে অর্থনীতিতে কম্পন তোলে। ১০,০০০ মানুষ কর্মহীন হন। ৫৩ বছর বয়সি টমি ৩০ বছর আগে ইয়ার্ন বিভাগে কাজ শুরু করেন; সেখানেই স্বামীকে পেয়েছেন।
বসার ঘরে সহকর্মী ও পারিবারিক ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, “স্রিটেক্সের বেতনে এই বাড়ি তুলেছি।” তিনি ও ২৪ বছর কাজ করা শ্রী লেস্তারি ফেব্রুয়ারির সেই দিনটি মনে করে চোখ মুছেন, যেদিন সবাইকে চূড়ান্ত বিদায় জানানো হয়।
স্কুলপড়ুয়া সন্তানের খরচ মেটাতে তাঁরা চিন্তিত। টমির বাড়ির সামনে ঝাল মুরগি ও ডাবের দোকান চালিয়ে কোনোমতে চলছেন, তবে আয় যথেষ্ট নয়।