০২:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে বড় ধাক্কা: সংকটের গভীরে

এক সময়ের গর্বিত শিল্প এখন সংকটে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প এক সময় ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস এবং পুরাতন জাহাজের লোহা সরবরাহের প্রধান ভিত্তি। “এশিয়ার স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড” খ্যাত এই শিল্পটি ১৯৮০-এর দশক থেকে ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শিল্পটি বড় ধরনের প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ সংকট, আন্তর্জাতিক নীতিমালা, প্রতিযোগিতা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত চাপে আজ এই শিল্প হুমকির মুখে।

বৈশ্বিক শিপিং বাজারে পরিবর্তন: কমে গেছে পুরাতন জাহাজ

শিপ ব্রেকিংয়ের প্রধান কাঁচামাল হলো পুরনো বা অচল হয়ে পড়া সমুদ্রগামী জাহাজ। বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণ ও পরিচালনার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এবং জাহাজে ব্যবহৃত ইঞ্জিন ও বডি-র স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরাতন জাহাজ বিক্রির হার অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাণিজ্যে গতি ফিরলেও অধিকাংশ শিপিং কোম্পানি তাদের পুরাতন জাহাজ আধুনিকায়ন করে পুনরায় ব্যবহার করছে, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের স্ক্র্যাপ ইন্ডাস্ট্রির জন্য বড় সংকেত।

আন্তর্জাতিক নীতিমালার চাপে পড়ে যাচ্ছে শিল্প

২০০৯ সালে গঠিত হংকং কনভেনশন এবং পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থা (IMO) ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী গোষ্ঠীর চাপের ফলে উন্নত দেশগুলো এখন আর সহজে জাহাজ বিক্রি করছে না যেসব দেশে পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষার মানদণ্ড মেনে চলা হয় না। বাংলাদেশ এখনো সম্পূর্ণরূপে এই মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। যার ফলে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর শিপিং কোম্পানিগুলি বাংলাদেশে তাদের জাহাজ ভাঙার জন্য পাঠানো কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘ ও ইইউ শিপিং রেগুলেশন অনুসারে এখন জাহাজ বিক্রির সময় দেশের পরিবেশগত অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া বাধ্যতামূলক।

ভারতের অগ্রযাত্রা ও প্রতিযোগিতা

এক সময় ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও, বর্তমানে ভারত শিপ রিসাইক্লিং ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গুজরাটের আলাং অঞ্চলের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো ইতোমধ্যে হংকং কনভেনশন অনুমোদিত এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে উন্নত দেশের জাহাজগুলো এখন বেশি পরিমাণে ভারতের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছেন প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে।

পরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা ইস্যু

বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে বহুদিন ধরেই শ্রমিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের কোনো নির্ধারিত নিরাপত্তা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ বা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেই। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, অনেক সময় প্রাণহানিও হয়। একই সঙ্গে লোহা কাটা, তেল ও রাসায়নিক নির্গমনের মাধ্যমে সামুদ্রিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশকে “নন-কমপ্লায়েন্ট” দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

অভ্যন্তরীণ সংকট: ডলার সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকট এবং এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে বিলম্বের কারণে উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে পুরনো জাহাজ আমদানি করতে পারছেন না। এছাড়া জাহাজ কিনে আনতে যে বৈদেশিক মুদ্রা লাগে, তা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে শিল্প উদ্যোক্তারা জাহাজ আনতে পারলেও সেগুলো বন্দরে আটকে থাকছে বা খালাস পেতে দেরি হচ্ছে। এতে ব্যবসার গতি মন্থর হচ্ছে।

লোহা বাজারে দাম হ্রাস: লাভ কমছে

শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম আউটপুট হলো স্ক্র্যাপ লোহা, যা দেশের গার্মেন্ট কারখানা, নির্মাণ খাত ও রড তৈরি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দেশে লোহা ও স্টিলের বাজারে ক্রমাগত দাম কমে যাচ্ছে, ফলে উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত লোহার ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের কম দামে রড ও স্টিল আমদানি, যা স্থানীয় বাজারকে চাপে ফেলছে।

নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব নীতিমালা বাস্তবায়ন, শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং ডলার সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকিং সহায়তা এবং শুল্কছাড়ের মতো প্রণোদনাও দেওয়া উচিত। না হলে এক সময়ের গৌরবময় শিল্পটি ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে যেতে পারে।

পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন

জাহাজ ভাঙা শিল্প শুধু একটি শিল্প নয়, এটি হাজারো শ্রমিকের জীবিকার উৎস, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে না পারলে এই খাত অস্তিত্ব হারাবে। এখনই সময় এই শিল্পকে আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার। অন্যথায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ তার অবস্থান হারাবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে বড় ধাক্কা: সংকটের গভীরে

০৫:০৫:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

এক সময়ের গর্বিত শিল্প এখন সংকটে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প এক সময় ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস এবং পুরাতন জাহাজের লোহা সরবরাহের প্রধান ভিত্তি। “এশিয়ার স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড” খ্যাত এই শিল্পটি ১৯৮০-এর দশক থেকে ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শিল্পটি বড় ধরনের প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ সংকট, আন্তর্জাতিক নীতিমালা, প্রতিযোগিতা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত চাপে আজ এই শিল্প হুমকির মুখে।

বৈশ্বিক শিপিং বাজারে পরিবর্তন: কমে গেছে পুরাতন জাহাজ

শিপ ব্রেকিংয়ের প্রধান কাঁচামাল হলো পুরনো বা অচল হয়ে পড়া সমুদ্রগামী জাহাজ। বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণ ও পরিচালনার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এবং জাহাজে ব্যবহৃত ইঞ্জিন ও বডি-র স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরাতন জাহাজ বিক্রির হার অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাণিজ্যে গতি ফিরলেও অধিকাংশ শিপিং কোম্পানি তাদের পুরাতন জাহাজ আধুনিকায়ন করে পুনরায় ব্যবহার করছে, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের স্ক্র্যাপ ইন্ডাস্ট্রির জন্য বড় সংকেত।

আন্তর্জাতিক নীতিমালার চাপে পড়ে যাচ্ছে শিল্প

২০০৯ সালে গঠিত হংকং কনভেনশন এবং পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থা (IMO) ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী গোষ্ঠীর চাপের ফলে উন্নত দেশগুলো এখন আর সহজে জাহাজ বিক্রি করছে না যেসব দেশে পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষার মানদণ্ড মেনে চলা হয় না। বাংলাদেশ এখনো সম্পূর্ণরূপে এই মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। যার ফলে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর শিপিং কোম্পানিগুলি বাংলাদেশে তাদের জাহাজ ভাঙার জন্য পাঠানো কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘ ও ইইউ শিপিং রেগুলেশন অনুসারে এখন জাহাজ বিক্রির সময় দেশের পরিবেশগত অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া বাধ্যতামূলক।

ভারতের অগ্রযাত্রা ও প্রতিযোগিতা

এক সময় ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও, বর্তমানে ভারত শিপ রিসাইক্লিং ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গুজরাটের আলাং অঞ্চলের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো ইতোমধ্যে হংকং কনভেনশন অনুমোদিত এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে উন্নত দেশের জাহাজগুলো এখন বেশি পরিমাণে ভারতের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছেন প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে।

পরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা ইস্যু

বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে বহুদিন ধরেই শ্রমিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের কোনো নির্ধারিত নিরাপত্তা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ বা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেই। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, অনেক সময় প্রাণহানিও হয়। একই সঙ্গে লোহা কাটা, তেল ও রাসায়নিক নির্গমনের মাধ্যমে সামুদ্রিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশকে “নন-কমপ্লায়েন্ট” দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

অভ্যন্তরীণ সংকট: ডলার সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকট এবং এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে বিলম্বের কারণে উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে পুরনো জাহাজ আমদানি করতে পারছেন না। এছাড়া জাহাজ কিনে আনতে যে বৈদেশিক মুদ্রা লাগে, তা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে শিল্প উদ্যোক্তারা জাহাজ আনতে পারলেও সেগুলো বন্দরে আটকে থাকছে বা খালাস পেতে দেরি হচ্ছে। এতে ব্যবসার গতি মন্থর হচ্ছে।

লোহা বাজারে দাম হ্রাস: লাভ কমছে

শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম আউটপুট হলো স্ক্র্যাপ লোহা, যা দেশের গার্মেন্ট কারখানা, নির্মাণ খাত ও রড তৈরি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দেশে লোহা ও স্টিলের বাজারে ক্রমাগত দাম কমে যাচ্ছে, ফলে উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত লোহার ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের কম দামে রড ও স্টিল আমদানি, যা স্থানীয় বাজারকে চাপে ফেলছে।

নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব নীতিমালা বাস্তবায়ন, শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং ডলার সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকিং সহায়তা এবং শুল্কছাড়ের মতো প্রণোদনাও দেওয়া উচিত। না হলে এক সময়ের গৌরবময় শিল্পটি ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে যেতে পারে।

পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন

জাহাজ ভাঙা শিল্প শুধু একটি শিল্প নয়, এটি হাজারো শ্রমিকের জীবিকার উৎস, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে না পারলে এই খাত অস্তিত্ব হারাবে। এখনই সময় এই শিল্পকে আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার। অন্যথায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ তার অবস্থান হারাবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।