০৩:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

ভিয়েতনামের আদলে বাংলাদেশে দারুচিনি চাষের সম্ভাবনা

ভিয়েতনামের সাফল্য: পাহাড়ে দারুচিনি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

ভিয়েতনাম বিশ্বে দারুচিনি উৎপাদনের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। দেশটির উত্তরাঞ্চলের লাও কাই, ইয়েন বাই ও কোয়াং নাম প্রদেশে পাহাড়ি জমিতে সহনশীল ও লাভজনক দারুচিনি চাষ কৃষকদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এখানকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু, উচ্চভূমি ও সুনির্দিষ্ট পাহাড়ি এলাকা দারুচিনি গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। ভিয়েতনাম সরকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও বাজারসুবিধা দিয়ে প্রায় দুই দশকে দারুচিনি রপ্তানিতে বিপুল প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রাকৃতিক ভেষজের চাহিদা বাড়ার কারণে দারুচিনি এখন শুধু খাবারে নয়, প্রসাধনী, ওষুধ এবং সুগন্ধি শিল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ভিয়েতনাম এই চাহিদা পূরণে এখন বিশ্বের অন্যতম সরবরাহকারী দেশ, এবং এই খাতে কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু ও সম্ভাবনাময় অঞ্চল

বাংলাদেশও ভৌগোলিকভাবে একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। বৃষ্টিপ্রবণতা, উষ্ণতা এবং উর্বর মাটি মিলিয়ে অনেক এলাকায় দারুচিনি চাষের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি), ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল (ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট), সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা এবং কক্সবাজারের মহেশখালী ও টেকনাফ অঞ্চলে দারুচিনি গাছের বাণিজ্যিক চাষের পরিবেশ রয়েছে।

দারুচিনি গাছ সাধারণত উঁচু জমি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। এটি ৭–৮ বছরে পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং এর বাকল মূলত মূল পণ্য। বাংলাদেশে অনেক পরিত্যক্ত বা কম ব্যবহারযোগ্য পাহাড়ি জমি দারুচিনি চাষের আওতায় আনলে স্থানীয় অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব।

গবেষণা ও উদ্যোগের ঘাটতি: চাষ শুরু হলেও নেই পরিকল্পিত নীতি

বাংলাদেশে অল্প পরিসরে বরিশাল, বান্দরবান ও সিলেটের কিছু কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে দারুচিনি গাছ রোপণ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এখনো দারুচিনি একটি “অপ্রচলিত মসলা” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম সীমিত।

চাষিদের অভিযোগ, দারুচিনি গাছের পরিচর্যা, রোগব্যাধি, বাজার সংযোগ এবং রপ্তানি প্রক্রিয়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নেই। ফলে কৃষকেরা আগ্রহী হলেও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিগত সহায়তা না পেয়ে চাষে এগোতে পারছেন না।

সম্ভাবনার ব্যবহার: পরিকল্পিত নীতি ও সরকারি সহায়তা জরুরি

ভিয়েতনামের মত সাফল্য অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথমত, দারুচিনি গাছ চাষের উপযোগী এলাকাগুলোর মাটি, জলবায়ু ও পরিবেশগত উপাদান নিয়ে গবেষণা জরুরি। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, চারা সরবরাহ এবং চাষকালীন ঋণসুবিধা দিতে হবে।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মান অনুসারে দারুচিনি প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী উদ্যোগের সঙ্গে মিল রেখে একটি বিশেষায়িত ‘স্পাইস পার্ক’ বা মসলা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র গড়ে তুললে দারুচিনির মতো উচ্চমূল্যের মসলার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

পাহাড়ি কৃষিকে রূপান্তর করতে পারে দারুচিনি চাষ

দারুচিনি শুধুমাত্র একটি মসলা নয়; এটি একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ফসল। বাংলাদেশে যে পরিমাণ পাহাড়ি ও অপ্রচলিত চাষযোগ্য জমি রয়েছে, তা সঠিক পরিকল্পনায় ব্যবহার করলে ভিয়েতনামের মতোই বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সঠিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ নিশ্চিত করা গেলে দারুচিনি হতে পারে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার কৃষির নতুন দিগন্ত।

সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে দারুচিনি চাষ বাংলাদেশের নতুন একটি রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত হতে পারে। এখন শুধু দরকার দৃঢ় সদিচ্ছা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

ভিয়েতনামের আদলে বাংলাদেশে দারুচিনি চাষের সম্ভাবনা

০৫:২৫:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

ভিয়েতনামের সাফল্য: পাহাড়ে দারুচিনি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

ভিয়েতনাম বিশ্বে দারুচিনি উৎপাদনের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। দেশটির উত্তরাঞ্চলের লাও কাই, ইয়েন বাই ও কোয়াং নাম প্রদেশে পাহাড়ি জমিতে সহনশীল ও লাভজনক দারুচিনি চাষ কৃষকদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এখানকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু, উচ্চভূমি ও সুনির্দিষ্ট পাহাড়ি এলাকা দারুচিনি গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। ভিয়েতনাম সরকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও বাজারসুবিধা দিয়ে প্রায় দুই দশকে দারুচিনি রপ্তানিতে বিপুল প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রাকৃতিক ভেষজের চাহিদা বাড়ার কারণে দারুচিনি এখন শুধু খাবারে নয়, প্রসাধনী, ওষুধ এবং সুগন্ধি শিল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ভিয়েতনাম এই চাহিদা পূরণে এখন বিশ্বের অন্যতম সরবরাহকারী দেশ, এবং এই খাতে কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু ও সম্ভাবনাময় অঞ্চল

বাংলাদেশও ভৌগোলিকভাবে একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। বৃষ্টিপ্রবণতা, উষ্ণতা এবং উর্বর মাটি মিলিয়ে অনেক এলাকায় দারুচিনি চাষের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি), ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল (ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট), সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা এবং কক্সবাজারের মহেশখালী ও টেকনাফ অঞ্চলে দারুচিনি গাছের বাণিজ্যিক চাষের পরিবেশ রয়েছে।

দারুচিনি গাছ সাধারণত উঁচু জমি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। এটি ৭–৮ বছরে পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং এর বাকল মূলত মূল পণ্য। বাংলাদেশে অনেক পরিত্যক্ত বা কম ব্যবহারযোগ্য পাহাড়ি জমি দারুচিনি চাষের আওতায় আনলে স্থানীয় অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব।

গবেষণা ও উদ্যোগের ঘাটতি: চাষ শুরু হলেও নেই পরিকল্পিত নীতি

বাংলাদেশে অল্প পরিসরে বরিশাল, বান্দরবান ও সিলেটের কিছু কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে দারুচিনি গাছ রোপণ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এখনো দারুচিনি একটি “অপ্রচলিত মসলা” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম সীমিত।

চাষিদের অভিযোগ, দারুচিনি গাছের পরিচর্যা, রোগব্যাধি, বাজার সংযোগ এবং রপ্তানি প্রক্রিয়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নেই। ফলে কৃষকেরা আগ্রহী হলেও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিগত সহায়তা না পেয়ে চাষে এগোতে পারছেন না।

সম্ভাবনার ব্যবহার: পরিকল্পিত নীতি ও সরকারি সহায়তা জরুরি

ভিয়েতনামের মত সাফল্য অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথমত, দারুচিনি গাছ চাষের উপযোগী এলাকাগুলোর মাটি, জলবায়ু ও পরিবেশগত উপাদান নিয়ে গবেষণা জরুরি। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, চারা সরবরাহ এবং চাষকালীন ঋণসুবিধা দিতে হবে।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মান অনুসারে দারুচিনি প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী উদ্যোগের সঙ্গে মিল রেখে একটি বিশেষায়িত ‘স্পাইস পার্ক’ বা মসলা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র গড়ে তুললে দারুচিনির মতো উচ্চমূল্যের মসলার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

পাহাড়ি কৃষিকে রূপান্তর করতে পারে দারুচিনি চাষ

দারুচিনি শুধুমাত্র একটি মসলা নয়; এটি একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ফসল। বাংলাদেশে যে পরিমাণ পাহাড়ি ও অপ্রচলিত চাষযোগ্য জমি রয়েছে, তা সঠিক পরিকল্পনায় ব্যবহার করলে ভিয়েতনামের মতোই বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সঠিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ নিশ্চিত করা গেলে দারুচিনি হতে পারে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার কৃষির নতুন দিগন্ত।

সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে দারুচিনি চাষ বাংলাদেশের নতুন একটি রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত হতে পারে। এখন শুধু দরকার দৃঢ় সদিচ্ছা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।