০৩:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

হোলি আর্টিজান হামলা নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদন: একটি বিশ্লেষণ

নিচে ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ইসলামিক স্টেট (আইএস) পরিচালিত সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনগুলোর মূল বিষয়বস্তু বাংলায় বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো:

হামলার রাত: দখলহত্যা ও ভয়াবহতা

দ্য গার্ডিয়ান জানায়, ১ জুলাই ২০১৬ রাতে গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায় অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচজন তরুণ অস্ত্রধারী ঢুকে পড়ে। তারা বিদেশি নাগরিক ও স্থানীয়দের জিম্মি করে এবং অনেককে জবাই করে হত্যা করে। হামলাকারীরা মেশিনগান, পিস্তল, গ্রেনেড এবং চাপাতি নিয়ে আসে। এ সময় তারা কোরআন থেকে আয়াত বলার জন্য জিম্মিদের বাধ্য করে—যারা বলতে পারেনি, তাদের হত্যা করা হয়।

নিহতদের পরিচয়: আন্তর্জাতিক শোক

পত্রিকাটি জানায়, ২০ জন জিম্মিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয় এবং ৩ জন বাংলাদেশি-আমেরিকান ছিলেন। নিহতদের বেশিরভাগই উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা কূটনৈতিক মহলে কাজ করতেন। এ হামলা আন্তর্জাতিকভাবে গভীর শোক ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি ও ভারতের সরকারগুলো নিন্দা প্রকাশ করে।

উদ্ধার অভিযান: অপারেশন থান্ডারবোল্ট

দ্য গার্ডিয়ান উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো বাহিনী ভোরে অভিযান চালায়, যেটিকে তারা “অপারেশন থান্ডারবোল্ট” নামে আখ্যা দেয়। কমান্ডোরা ৫০ মিনিটের অভিযানে পাঁচজন জঙ্গিকে হত্যা করে এবং ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করে। এই অভিযানই অবসান ঘটায় প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী এই পরিস্থিতির।

হামলার দায় স্বীকার: আইএসের হুমকি

হামলার পরপরই আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং দাবি করে যে, এটি ছিল “ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলোর” নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা। দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, হামলার ধরন, কৌশল এবং ধর্মীয় পরিচয় যাচাইয়ের পদ্ধতি আইএসের পূর্ববর্তী হামলার ধরন অনুসরণ করে। তবে বাংলাদেশ সরকার তখন আইএসের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এবং স্থানীয় উগ্রবাদীদের দায়ী করে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা কৌশল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় শোক ঘোষণা করেন এবং একযোগে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানান। দ্য গার্ডিয়ান বিশ্লেষণে উল্লেখ করে, এই হামলা বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামো এবং তরুণ সমাজে জঙ্গিবাদী প্রভাব সম্পর্কে গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের এই হামলায় অংশগ্রহণ দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে।

হামলাকারীদের পরিচয়: সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরা

দ্য গার্ডিয়ান বিস্তারিতভাবে জানায়, হামলাকারীরা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া তরুণ। এই প্রেক্ষাপটে পত্রিকাটি প্রশ্ন তোলে: কেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা এমন চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে? সামাজিক ও ধর্মীয় বিভ্রান্তি, অনলাইনে উগ্রবাদী মতাদর্শের বিস্তার এবং পরিচয় সংকট—এসব কারণ তুলে ধরা হয়।

তদন্তবিচার ও সাজা

পত্রিকাটি জানায়, হামলার পর কয়েক মাসের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকজন জঙ্গিকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করে এবং মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীকে খুঁজে বের করে হত্যা করে। ২০১৯ সালে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা চলে এবং ২০২৫ সালে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয় (যা পরে কিছু ক্ষেত্রে যাবজ্জীবনে রূপান্তর হয়)। দ্য গার্ডিয়ান এই বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখে এবং একে ‘ধীরে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক অগ্রগতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

প্রতীকী প্রতিক্রিয়া: স্মৃতিস্তম্ভ ও পুনরায় চালু

২০১৮ সালে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে গুলশানে “দীপ্ত শপথ” নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। হোলি আর্টিজান বেকারি ২০১৭ সালে অন্য ঠিকানায় চালু হয়, যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ, পুনর্জন্ম এবং ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে বলে দ্য গার্ডিয়ান মন্তব্য করে।

হোলি আর্টিজান হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতের নাম। দ্য গার্ডিয়ান এই হামলার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, মানবিক মূল্য এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া—সবকিছুই গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছে। এটি শুধু একটি জঙ্গি হামলা নয়, বরং একটি সমাজের আত্মা, নিরাপত্তা কাঠামো এবং তরুণদের মনোজগতে সংঘটিত এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের চিহ্ন।

হোলি আর্টিজান হামলা নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদন: একটি বিশ্লেষণ

০৬:০৭:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

নিচে ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ইসলামিক স্টেট (আইএস) পরিচালিত সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনগুলোর মূল বিষয়বস্তু বাংলায় বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো:

হামলার রাত: দখলহত্যা ও ভয়াবহতা

দ্য গার্ডিয়ান জানায়, ১ জুলাই ২০১৬ রাতে গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায় অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচজন তরুণ অস্ত্রধারী ঢুকে পড়ে। তারা বিদেশি নাগরিক ও স্থানীয়দের জিম্মি করে এবং অনেককে জবাই করে হত্যা করে। হামলাকারীরা মেশিনগান, পিস্তল, গ্রেনেড এবং চাপাতি নিয়ে আসে। এ সময় তারা কোরআন থেকে আয়াত বলার জন্য জিম্মিদের বাধ্য করে—যারা বলতে পারেনি, তাদের হত্যা করা হয়।

নিহতদের পরিচয়: আন্তর্জাতিক শোক

পত্রিকাটি জানায়, ২০ জন জিম্মিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয় এবং ৩ জন বাংলাদেশি-আমেরিকান ছিলেন। নিহতদের বেশিরভাগই উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা কূটনৈতিক মহলে কাজ করতেন। এ হামলা আন্তর্জাতিকভাবে গভীর শোক ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি ও ভারতের সরকারগুলো নিন্দা প্রকাশ করে।

উদ্ধার অভিযান: অপারেশন থান্ডারবোল্ট

দ্য গার্ডিয়ান উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো বাহিনী ভোরে অভিযান চালায়, যেটিকে তারা “অপারেশন থান্ডারবোল্ট” নামে আখ্যা দেয়। কমান্ডোরা ৫০ মিনিটের অভিযানে পাঁচজন জঙ্গিকে হত্যা করে এবং ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করে। এই অভিযানই অবসান ঘটায় প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী এই পরিস্থিতির।

হামলার দায় স্বীকার: আইএসের হুমকি

হামলার পরপরই আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং দাবি করে যে, এটি ছিল “ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলোর” নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা। দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, হামলার ধরন, কৌশল এবং ধর্মীয় পরিচয় যাচাইয়ের পদ্ধতি আইএসের পূর্ববর্তী হামলার ধরন অনুসরণ করে। তবে বাংলাদেশ সরকার তখন আইএসের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এবং স্থানীয় উগ্রবাদীদের দায়ী করে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা কৌশল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় শোক ঘোষণা করেন এবং একযোগে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানান। দ্য গার্ডিয়ান বিশ্লেষণে উল্লেখ করে, এই হামলা বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামো এবং তরুণ সমাজে জঙ্গিবাদী প্রভাব সম্পর্কে গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের এই হামলায় অংশগ্রহণ দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে।

হামলাকারীদের পরিচয়: সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরা

দ্য গার্ডিয়ান বিস্তারিতভাবে জানায়, হামলাকারীরা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া তরুণ। এই প্রেক্ষাপটে পত্রিকাটি প্রশ্ন তোলে: কেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা এমন চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে? সামাজিক ও ধর্মীয় বিভ্রান্তি, অনলাইনে উগ্রবাদী মতাদর্শের বিস্তার এবং পরিচয় সংকট—এসব কারণ তুলে ধরা হয়।

তদন্তবিচার ও সাজা

পত্রিকাটি জানায়, হামলার পর কয়েক মাসের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকজন জঙ্গিকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করে এবং মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীকে খুঁজে বের করে হত্যা করে। ২০১৯ সালে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা চলে এবং ২০২৫ সালে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয় (যা পরে কিছু ক্ষেত্রে যাবজ্জীবনে রূপান্তর হয়)। দ্য গার্ডিয়ান এই বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখে এবং একে ‘ধীরে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক অগ্রগতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

প্রতীকী প্রতিক্রিয়া: স্মৃতিস্তম্ভ ও পুনরায় চালু

২০১৮ সালে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে গুলশানে “দীপ্ত শপথ” নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। হোলি আর্টিজান বেকারি ২০১৭ সালে অন্য ঠিকানায় চালু হয়, যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ, পুনর্জন্ম এবং ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে বলে দ্য গার্ডিয়ান মন্তব্য করে।

হোলি আর্টিজান হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতের নাম। দ্য গার্ডিয়ান এই হামলার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, মানবিক মূল্য এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া—সবকিছুই গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছে। এটি শুধু একটি জঙ্গি হামলা নয়, বরং একটি সমাজের আত্মা, নিরাপত্তা কাঠামো এবং তরুণদের মনোজগতে সংঘটিত এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের চিহ্ন।