জন্ম ও শৈশব
বাংলাদেশের বর্ষীয়ান অভিনেত্রী দিলারা জামান জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আসুতোষপুর গ্রামে, ১৯৪৩ সালের ১৯ জুন। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে এবং বসবাস শুরু করে রাজশাহীতে। সেখানেই তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে। ছোটবেলা থেকেই বই পড়া ও আবৃত্তি ছিল তাঁর প্রিয় অভ্যাস। স্কুলে পড়ার সময়ই তাঁর মধ্যে নাটকের প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে।
অভিনয়ে আগ্রহ ও পারিবারিক অনুপ্রেরণা
দিলারা জামানের অভিনয় জীবনে প্রবেশে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর মা ও বড় ভাই। তাঁর মা সাংস্কৃতিক অনুরাগী ছিলেন, এবং ভাই নাটক করতেন। পারিবারিকভাবে তাঁরা সাহিত্যের চর্চা করতেন। রাজশাহী বেতারে আবৃত্তি ও নাটকে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় পূর্ণাঙ্গভাবে নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন।
প্রথম অভিনয় ও টেলিভিশনে যাত্রা
১৯৬২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে দিলারা জামান প্রথম অভিনয় করেন ‘ত্রয়ী’ নামের একটি নাটকে। এটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম নাট্য অভিজ্ঞতা, যা তাঁকে টেলিভিশন অঙ্গনে পরিচিত করে তোলে। এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত নাটকে অভিনয় শুরু করেন এবং দ্রুতই খ্যাতি লাভ করেন।
অভিনয়জীবনের বিস্তার
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে দিলারা জামান অসংখ্য জনপ্রিয় নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘সংশপ্তক’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘নক্ষত্রের রাত’ প্রভৃতি। চলচ্চিত্রে তিনি ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘ব্র্যান্ডেড বিউটি’, ‘ব্রিজ’, ‘চোরাবালি’, ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’, ‘দুই দুঃখী’ ইত্যাদিতে অভিনয় করেছেন। মায়ের চরিত্রে তাঁর আবেগময় অভিনয় দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন ও আন্তর্জাতিক মঞ্চ
দিলারা জামান একাধিক টিভি বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছেন। বিজ্ঞাপনে তাঁর অনবদ্য উপস্থিতি তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন — বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণে গিয়েছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
দিলারা জামান তাঁর দীর্ঘ অভিনয় জীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক সম্মান ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাচসাস পুরস্কারসহ নানা নাট্যসংগঠন ও চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননায় ভূষিত হন।
সামাজিক ও মানবিক কাজ
শুধু অভিনেত্রী হিসেবে নয়, দিলারা জামান একজন মানবতাবাদী কর্মী হিসেবেও পরিচিত। তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ও শিশু অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে ভূমিকা রেখেছেন। সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও নারী সশক্তিকরণ নিয়ে কাজ করেছেন একাধিক সংগঠনের সঙ্গে মিলিত হয়ে।
ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক সহায়তা
দিলারা জামান বিবাহিত। তাঁর স্বামী ছিলেন মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পরিবার সব সময় তাঁর অভিনয় জীবনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। স্বামী ও সন্তানদের সহায়তা তাঁকে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বিশেষ করে স্বামী তাঁর নাট্যজীবনের প্রতি গর্বিত ছিলেন এবং সবসময় সহযোগিতা করেছেন।
বিতর্ক বা স্ক্যান্ডাল
দিলারা জামান সাধারণত বিতর্কের বাইরে থাকা একজন অভিনেত্রী। তাঁর ব্যক্তিজীবন বা কর্মজীবন নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কেলেঙ্কারির ইতিহাস নেই। তিনি শান্তিপূর্ণ, সজ্জন এবং মার্জিত জীবনযাপন করেছেন।
বর্তমানে তিনি কোথায় এবং কেমন আছেন?
বর্তমানে দিলারা জামান ঢাকায় বসবাস করছেন। বয়সজনিত কারণে এখন তিনি নিয়মিত অভিনয় করেন না, তবে মাঝে মাঝে বিশেষ নাটক বা উৎসব উপলক্ষে কাজ করেন। তিনি বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন, বই পড়েন, মাঝে মাঝে নাট্য সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। তাঁর মেয়ে ও নাতিনাতনিদের সঙ্গে তিনি দারুণ সময় কাটান।
দিলারা জামান এক জীবনে যেমন এক অনন্য অভিনয় অধ্যায় রচনা করেছেন, তেমনি একটি সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অভিনয়, শিক্ষা, মূল্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব — সবমিলিয়ে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতিসেবী। বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্র ইতিহাসে তাঁর নাম চিরভাসমান হয়ে থাকবে।