ঘর সাজানোর রঙিন বিপ্লব শুরু করেছিল আইকিয়া
বিশ্বজুড়ে ঘর সাজানোর ধরনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে যে প্রতিষ্ঠানটি, সেটি নিঃসন্দেহে আইকিয়া। আপনি যদি কখনো এই সুইডিশ প্রতিষ্ঠানের দোকানে গিয়ে ‘বিলি’ বুকশেলফ, ‘রোডালম’ ফটো ফ্রেম কিংবা ‘গ্লিমা’ টি-লাইট না কিনেও থাকেন, তবু কোনো না কোনোভাবে আপনি হয়তো ‘স্টকহোম’ কার্পেট, ‘রিন্নিগ’ চায়ের তোয়ালে বা ‘একটর্প’ সোফার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছেন কোনো বন্ধু বা এয়ারবিএনবিতে গিয়ে।
বিশ্বের ৬৩টি দেশে আইকিয়ার ৪৮০টিরও বেশি দোকান রয়েছে, এবং প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ইউরো (৫২ বিলিয়ন ডলার) আয় করেছে। তারা সুইডিশ ন্যূনতমতাবাদী ডিজাইনকে সবার জন্য সহজলভ্য করে তুলেছে — সাধারণত সাদা বা বিউজ রঙের MDF ফার্নিচারের মাধ্যমে। আইকিয়াকে মনে করা হয় ব্যবহারিক, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং ফ্ল্যাটপ্যাক ফার্নিচার গাঁথতে গিয়ে দম্পতিদের তর্কের এক অনিবার্য অংশ!
বস্ত্রের রঙিন জাদু প্রদর্শনী
তবে এডিনবার্গের ডোভকোট স্টুডিওতে চলমান একটি নতুন প্রদর্শনী — “ম্যাজিক্যাল প্যাটার্নস” — আইকিয়ার আরও উজ্জ্বল, সাহসী এবং রঙিন এক দিক তুলে ধরেছে: এর বস্ত্রশিল্প।
প্রতিষ্ঠার সময় (১৯৪৩ সালে) আইকিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল আসবাব তৈরি। তখন বস্ত্র খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, আর যে সফট ফার্নিশিংস তারা করত, সেগুলো ছিল ধূসর এবং একঘেয়ে রঙে। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় বস্ত্রের রেনেসাঁ শুরু হয়। শহরের পথে পথে নারীরা জ্যামিতিক ডিজাইনের পোশাকে হাঁটত, পোলকা ডটস ও পেইজলি প্রিন্টের মিনি স্কার্ট ছিল ফ্যাশনের শীর্ষে।
এই ট্রেন্ডে দ্রুত সাড়া দেয় আইকিয়ার কর্তারা। তাঁরা তরুণী নারী শিল্পীদের একটি নতুন দল গঠন করেন — যেমন বিটেন হোজমার্ক, ইঙ্গার নিলসন এবং ভিভিয়ানে সজোলিন — যাঁদের কাজ ছিল একটি স্বতন্ত্র ডিজাইন স্টাইল তৈরি করা যা আইকিয়ার ক্রেতাদের পছন্দ হবে।
রঙ ও নকশার উৎসব
ফলে শুরু হয় রঙ, নকশা ও কারিগরি উদ্ভাবনের এক উৎসব। ১৯৭০ সালের মধ্যে আইকিয়ার বিক্রির এক-চতুর্থাংশই ছিল বস্ত্রজাত পণ্য। এ প্রদর্শনীতে সুইডেনের আলমহুলতে অবস্থিত আইকিয়া মিউজিয়াম থেকে আনা ১৮০টি ভিন্ন বস্ত্রনমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে — সুইডেনের বাইরে এটি প্রথমবারের মতো এই সংগ্রহের প্রদর্শনী।
এই প্রদর্শনীতে একরঙা ন্যূনতমতাবাদী ডিজাইনের দেখা কমই মেলে; বরং চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স ও উজ্জ্বল রঙই এখানে প্রধান আকর্ষণ। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে ইনেজ সেভেনসন ডিজাইন করা “স্ট্রিক্স” ও “স্ট্রাক্স” নামের কাপড়গুলো ছিল নীল, কমলা, সবুজ, বাদামি, হলুদ ও সাদা রঙের স্ট্রাইপে ভরা।
দেখতে সাদামাটা মনে হলেও, এই ডিজাইনগুলো ছিল কারিগরি উদ্ভাবনের ফল। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো অনুভূমিক স্ট্রাইপ কাপড়ে প্রিন্ট করা সম্ভব হয়েছিল, যা আগে বুননের মাধ্যমে তৈরি করতে হতো — ফলে দামও বেড়ে যেত।
বস্ত্রশিল্পে এক স্বর্ণযুগের সূচনা
এই ডিজাইন দুটিই আইকিয়ার বস্ত্রশিল্পের স্বর্ণযুগের সূচনা করে। প্রতিষ্ঠানটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ডিজাইনারদের অন্তর্ভুক্ত করে — যেমন গোটা ট্রাগার্ড, স্বেন ফ্রিস্টেড এবং ১৯৭০ সালে গঠিত ১০-গ্রুপেন (যার সদস্য ছিলেন ইনেজ সেভেনসন)।
তারা ম্যারিমেক্কোর (ফিনল্যান্ডের জনপ্রিয় বস্ত্র কোম্পানি) এবং ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার জান্দ্রা রোডসের সঙ্গেও কাজ করেছে — যিনি ফ্রেডি মারকুরি ও প্রিন্সেস ডায়ানার মতো তারকাদের পোশাক ডিজাইন করেছেন। তবে যারাই ডিজাইনার হোন না কেন, আইকিয়ার বস্ত্রে সাধারণত জোর দেওয়া হতো প্রাণবন্ততা এবং রঙিন খেলাধুলায়।
বিপণন কৌশল হিসেবে বস্ত্রের ব্যবহার
এই প্রদর্শনীটি যেহেতু আইকিয়ার নিজস্ব জাদুঘরের, তাই এটি আইকিয়ার নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চায়। প্রদর্শনীতে যে রঙিন প্যাটার্নের প্রাধান্য, সেটিও এই ইচ্ছারই প্রতিফলন। যেমন, ২০১৪ সালের “অ্যানিকেন” ডিজাইনে পিংক স্ট্রাইপের ওপর নাচতে থাকা ব্রকলি ফুল ও বাটনের ছাপ রয়েছে।
আবার ১৯৮৫ সালের বিতর্কিত “রানডিগ বানান” প্রিন্ট — যেখানে কলা ও স্ট্রাইপ একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে — আজ বেশ জনপ্রিয়।
সত্তরের ও আশির দশকে আইকিয়ার বস্ত্র বিভাগ পরিচালনা করা ভিভিয়ানে সজোলিন একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কিভাবে তারা নতুন নকশাগুলোকে বিপণন কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতেন — প্রেসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, ক্যাটালগের কভার সাজাতে, দোকানের জানালায় টাঙাতে এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে।
তবে বাস্তবতা হলো, এসব দৃষ্টিনন্দন নকশার চেয়েও সাধারণ ও কম উজ্জ্বল কাপড়গুলোই বছরের পর বছর বহু বিলিয়ন ডলারের বিক্রির মূল চালিকা শক্তি।
একটি চায়ের তোয়ালে দিয়ে বিশ্ব জয়
তবুও, আইকিয়ার বস্ত্রশিল্পে প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘স্ট্রিক্স’ স্ট্রাইপ থেকে শুরু করে ১৯৯০-এর দশকের “চিন্ট্জ ছুঁড়ে ফেলো” ক্যাম্পেইন পর্যন্ত — আইকিয়া এমন সব বস্ত্র ডিজাইনকে জনপ্রিয় করেছে, যা তরুণ, আধুনিক এবং বিশ্বজয়ী।
এটা প্রমাণিত — একটি ‘রিন্নিগ’ চায়ের তোয়ালেও ঘরের সৌন্দর্যে বিপ্লব আনতে পারে।