শৈশব ও পরিবার
রাণী হামিদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ সালের ১৪ জুলাই, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সিলেট শহরে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল সাইয়েদা জাসিমুননেসা খাতুন। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং পরিবারটি ছিল শিক্ষিত ও অভিজাত। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে তাঁর। তবে সমাজের রক্ষণশীলতার কারণে তখন মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। সে সময় তাঁর মা তাঁকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বললেও তিনি নিঃশব্দে নিজের মনে খেলাধুলার স্বপ্ন লালন করে গেছেন।
বিয়ে ও সংসার জীবন
১৯৫৯ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার এম এ হামিদকে। তাঁর স্বামী ছিলেন একজন ক্রীড়া সংগঠক এবং বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। রাণী হামিদ নিজেও স্বামীর উৎসাহে খেলাধুলার প্রতি আরও মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তাঁদের তিন সন্তানই খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বড় ছেলে কায়সার হামিদ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও অধিনায়ক ছিলেন, সোহেল হামিদ স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়ন এবং আরেক সন্তান শাহজাহান হামিদ ববি হ্যান্ডবল ও ফুটবল খেলতেন।
দাবার প্রতি অনুরাগ ও দেরিতে শুরু
রাণী হামিদ দাবা খেলতে শেখেন তাঁর স্বামীর সহচর্যে। তবে এই খেলায় তাঁর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় বয়স যখন ৩৪। সময়টি ছিল ১৯৭৮ সাল। অনেকেই তখন বলেছিলেন, এত বয়সে আবার দাবা শুরু করে কী হবে? কিন্তু রাণী হামিদ থেমে থাকেননি। নিজের একাগ্রতা, প্রতিভা ও অধ্যবসায়ে তিনি দ্রুত দেশের শীর্ষ নারী দাবাড়ুতে পরিণত হন।
জাতীয় দাবায় আধিপত্য
১৯৭৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর টানা ছয় বছর, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এ ধারাবাহিকতা সেখানেই থেমে যায়নি; পরবর্তী তিন দশকজুড়ে তিনি আরও বহুবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন। মোট ২০ বার তিনি এই শিরোপা জিতেছেন, যা আজও এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রেকর্ড।
আন্তর্জাতিক পরিসরে পদার্পণ
১৯৮৩ সালে তিনি প্রথম বিদেশে খেলার সুযোগ পান। সে বছর তিনি ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর আরও দুইবার—১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সালে—তিনি এই শিরোপা অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালেই তিনি ফিদে থেকে ‘নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার’ (WIM) খেতাব লাভ করেন, যা ছিল বাংলাদেশের কোনো দাবাড়ুর জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক উপাধি।
অলিম্পিয়াড ও বিশ্বমঞ্চে অংশগ্রহণ
রাণী হামিদ ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে দাবা অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। মাত্র একটি অলিম্পিয়াড বাদে তিনি প্রতিবার দেশের হয়ে খেলেছেন। এমনকি ২০২৪ সালেও, ৮০ বছর বয়সে তিনি চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম ছয়টি রাউন্ডের মধ্যে পাঁচটিতে জয় লাভ করেন। এত বয়সে এই সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলেও বিস্ময় সৃষ্টি করে।
পদক ও স্বীকৃতি
২০১৭ সালে কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের বিভাগে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ২০১৮ সালে জোনাল চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি বিশ্ব দাবা কাপে ‘সাংবাদিক পছন্দ পুরস্কার’ লাভ করেন। জাতীয়ভাবে তিনি একাধিকবার সম্মানিত হয়েছেন এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন তাঁকে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে।
নারী ক্ষমতায়নে প্রেরণাদায়ী চরিত্র
রাণী হামিদ শুধু একজন সফল দাবাড়ুই নন, বরং বাংলাদেশের নারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। তিনি প্রমাণ করেছেন, বয়স কখনোই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাধা হতে পারে না। যখন তিনি দাবা খেলা শুরু করেন, তখন দেশে গুটি কয়েক নারী দাবাড়ুই ছিলেন না। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে মেয়েরা দাবা খেলায় অংশ নিচ্ছে, আর এই আন্দোলনের পেছনে রাণী হামিদই ছিলেন মূল প্রেরণা।
লেখক ও শিক্ষিকা হিসেবে অবদান
দাবা খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি একটি বই লিখেছেন—‘দাবা খেলার আইন ও কানুন’। বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটি নবীন দাবাড়ুদের জন্য পথপ্রদর্শকের মতো কাজ করে। এছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন দাবা ক্লাবে গিয়ে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন এবং দাবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেন।
বর্তমান জীবন
২০২৫ সালে রাণী হামিদের বয়স ৮১ হলেও তিনি আজও সক্রিয়ভাবে দাবা খেলেন এবং আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এখনো দেশের নারী দাবা দলের অভিভাবকের মতো ভূমিকা পালন করছেন, নবীন খেলোয়াড়দের পরামর্শ দেন এবং দাবা চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
কেবল একটি নাম নয়
রাণী হামিদ কেবল একটি নাম নয়—একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে সংগ্রাম, সাধনা ও সাফল্যের গল্প। তিনি দেখিয়েছেন, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা থাকলে বয়স, সময় কিংবা প্রতিবন্ধকতা—কোনো কিছুই স্বপ্নপূরণে বাধা হতে পারে না। বাংলাদেশ ক্রীড়াজগতে তিনি সত্যিই এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যাঁর নাম বহুদিন ধরে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হবে।