শৈশব ও কৈশোর: এক বিক্ষুব্ধ প্রতিভার জন্ম
১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন ফরীদী। পিতা এ.টি.এম. নূরুল ইসলাম ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মা ফরিদা ইসলাম গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবের কিছু সময় কাটে মাদারীপুরের কালিগঞ্জে, পরে ঢাকার সূত্রাপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন চিন্তাশীল, গভীর পর্যবেক্ষণক্ষম ও নাট্যপ্রবণ। কৈশোর থেকেই সমাজের বৈষম্য ও মানুষের আচরণ তাঁকে দারুণভাবে ভাবাতো, যা পরবর্তীতে তাঁর অভিনয়ে প্রকাশ পায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ও অভিনয়ের সূচনা
প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন, তবে মুক্তিযুদ্ধের কারণে পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয়। পরে ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই স্নাতক সম্পন্ন করেন। জাহাঙ্গীরনগরে থাকাকালীন তিনি নাট্যচর্চায় যুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের নাট্যোৎসবে প্রধান আয়োজক হিসেবে কাজ করেন এবং সেলিম আল দীনের পথনাট্য ‘শকুন্তলা’ দিয়ে মঞ্চে প্রথম পা রাখেন। এরপর ‘ফণী মনসা’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ এবং সর্বোপরি ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা তে তাঁর অভিনয় তাঁকে বাংলা মঞ্চের কিংবদন্তি করে তোলে।
দেওয়ান গাজীর কিস্সা: মঞ্চে বাস্তবতার রাজনীতি
এই নাটকে ফরীদীর চরিত্র ছিল এক স্ফীত অহংয়ের প্রতিনিধি, যিনি স্থানীয় রাজনীতি, দুর্নীতি এবং জনমানসের বিভ্রান্তিকে নিজের সুবিধায় ব্যবহার করেন। ফরীদীর সংলাপ বলার ধরণ, দৃষ্টি, শরীরী ভাষা এবং সংলাপের ফাঁকে বিরতি নেওয়ার কৌশল একে অসাধারণ একটি চরিত্রে পরিণত করে। তিনি ছিলেন উপস্থিতির অভিনেতা—মঞ্চে এলেই আলো-অন্ধকারের সব ফোকাস কেন্দ্রীভূত হতো তাঁর শরীরের প্রতিটি সঞ্চরণে।
সংশপ্তক: টেলিভিশনে সামাজিক অসুন্দরের প্রতীক
বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’-এ “কানকাটা রমজান” চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদীর অভিনয় ছিল অনবদ্য। রমজান ছিলেন একটি লাম্পট্যপূর্ণ, ক্ষমতালোভী, হিংস্র ও শঠ চরিত্র—যাকে ফরীদী এমনভাবে ফুটিয়ে তোলেন যে, দর্শক তাঁর ভয়ংকরত্বে স্তব্ধ হয়ে যেতো। তাঁর সংলাপের মাঝে বিরতি, চোখে তীব্র দৃষ্টি, গলার স্বরের উত্থান-পতন এবং আচরণে নির্মমতা এমনভাবে মিশ্রিত ছিল যে এই চরিত্রটি বাংলাদেশের টিভি ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। ফরীদী রমজানকে রূপ দিয়েছেন এক সামাজিক ব্যাধির প্রতিমূর্তি হিসেবে।
চলচ্চিত্রে খলনায়ক: ভয় ও বাস্তবতার তীব্র সম্মিলন
বাংলা চলচ্চিত্রে হুমায়ূন ফরীদীর সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান ছিল খলনায়ক হিসেবে। তাঁর অভিনীত ‘শঙ্কিত নয়ন’, ‘সন্ত্রাস’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘ভণ্ড’, ‘বীরপুরুষ’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’–সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি ভয়ের এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেন। তিনি কখনো চিৎকার করে ভয় দেখাতেন না—বরং চুপ থেকে, নীরবতা দিয়ে, চোখের ভাষা ও শরীরী ভাষার মাধ্যমে এমন এক চাপ সৃষ্টি করতেন যা দর্শকের স্নায়ুতে গিয়ে আঘাত করতো। তাঁর ভিলেনরা ছিল চিন্তাশীল, প্রগতিশীল শয়তান—যাদের ভয় করা শুধু নয়, বোঝারও প্রয়োজন ছিল।
মেহেরজান: রাজাকারের নিষ্ঠুর চরিত্রের নির্মাণ
‘মেহেরজান’ চলচ্চিত্রে ফরীদী অভিনয় করেন এক রাজাকারের ভূমিকায়—এটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম গভীর ও মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র। রাজাকার চরিত্রটিতে তিনি মানবিকতার বিপরীত চরিত্রের সংজ্ঞা রচনা করেন—যেখানে করুণা, প্রেম বা দয়া বলে কিছু নেই; আছে শুধু শক্তি, স্বার্থ ও ভ্রান্ত আদর্শে বিশ্বাস।
দৃশ্য: “তুমি কি জানো, এই দেশ কার?”
এক অন্ধকার ঘরে ফরীদীর চরিত্র প্রবেশ করে। সামনে বসে কাঁদছেন এক বৃদ্ধা, যার সন্তানকে সদ্য হত্যা করা হয়েছে। ফরীদী ধীরে হাঁটেন। চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি, ঠোঁটে এক চিমটি হিংস্র হাসি।
তিনি বলেন—
“তুমি কি জানো, এই দেশ কার?”
তারপর হাত রাখেন বৃদ্ধার কাঁধে। একদিকে সান্ত্বনার ভঙ্গি, কিন্তু সেই হাতচাপ চাপতে চাপতে হয়ে ওঠে ভয়ানক শক্ত।
“তোমার ছেলেটা আমাকে চিনতো না। ভুল করেছে। এখন সেই ভুলটা ঠিক করে দিলাম।”
এই সংলাপের পর তাঁর চোখে ছিল কৃতকর্মের অহংকার, ঠোঁটে অর্ধেক হাসি, অর্ধেক ঘৃণা। দৃশ্যটি শেষ হয় তাঁর পিছন ফিরে ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার মাধ্যমে—কিন্তু দর্শকের ভেতরে তখনো জমে থাকে এক অতল আতঙ্ক।
পারিবারিক জীবন ও সম্পর্ক
হুমায়ূন ফরীদীর প্রথম স্ত্রী ছিলেন নাজমুন আরা বেগম মিনু। তাঁদের একমাত্র কন্যার নাম শরারাত ইসলাম দেবযানী। পরে তিনি বিয়ে করেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে, তবে তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না এবং এই দাম্পত্য জীবনও বিচ্ছেদে গিয়ে শেষ হয়।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
- ২০০৪ সালে‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা নির্বাচিত হন।
- ২০১৮ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
- টেলিভিশন,মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা।
হুমায়ূন ফরীদী: সর্বকালের শ্রেষ্ঠ?
বাংলা অভিনয়ের ইতিহাসে এমন একজন শিল্পী বিরল—যিনি একইসঙ্গে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে নিজেকে সমানতালে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। ফরীদী ছিলেন সংলাপের চেয়ে বেশি অভিব্যক্তির অভিনেতা। তিনি ছিলেন ভয় দেখানোর চেয়ে চরিত্র নির্মাণের শিল্পী। তাঁর মতো অভিনয়শিল্পী শুধু চরিত্র ধারণ করতেন না—চরিত্র হয়ে উঠতেন। তাঁর প্রতিটি অভিনয় আজও মানুষকে কাঁদায়, স্তব্ধ করে, ভাবায়।
জীবন্ত অভিধান
হুমায়ূন ফরীদী ছিলেন অভিনয়ের এক জীবন্ত অভিধান। তাঁর প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি দৃষ্টি আর প্রতিটি নিঃশ্বাস আজো বাংলার নাট্যজগত ও চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করে। তিনি ছিলেন নিছক শিল্পী নন—এক জনসংস্কৃতি। বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম থাকবে চিরকাল, শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ের সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে।