ভূমিকাঃ ‘অন্ধকার দিবস’, তবু যুদ্ধ ঠেকাতে আপস
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সদ্য ঘোষিত বাণিজ্যচুক্তি অধিকাংশ ইউরোপীয় রপ্তানিপণ্যের উপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে, অথচ মার্কিন গাড়ি ও কিছু কৃষিপণ্যের শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনছে। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী একে ‘ইউরোপের জন্য অন্ধকার দিন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সমালোচনার ঝড় উঠলেও ব্রাসেলসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য—পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধের ঝুঁকি এড়াতেই এ রকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
চুক্তির প্রধান দিকগুলো
- • ইউরোপীয় বেশিরভাগ রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ শুল্ক
- • মার্কিন গাড়ি ও নির্বাচিত কৃষিপণ্যে শূন্য শুল্ক
- • ইউরোপের কড়া ডিজিটাল নিয়ম-কানুন অপরিবর্তিত
- • মুরগি-গরুর মতো সংবেদনশীল কৃষিপণ্যে শুল্ক ছাড় অর্পিত নয়
- • আমেরিকান জ্বালানি কেনার প্রতিশ্রুতি—যা রাশিয়া-নির্ভরতা কমানোর বর্তমান নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
কিভাবে শুরু হল চাপ
২ এপ্রিল ‘লিবারেশন ডে’-তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন। এরপর হুমকি বেড়ে ৫০ শতাংশে, পরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যায়। শুরুতে ব্রাসেলস ভেবেছিল কম শুল্ক আদায় করা যাবে বা প্রয়োজনে পাল্টা শুল্ক দেওয়া হবে। কিন্তু ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের স্বার্থ মেলাতে গিয়ে দরকষাকষি জটিল হয়। একের পর এক বৈঠক, ফোনকল আর বার্তার শেষে স্পষ্ট হয়—হুমকি এবার সত্যি হতে পারে।
কঠিন দরকষাকষি ও স্কটল্যান্ডের গোলফ কোর্স
ইইউ বাণিজ্যকমিশনার মারোশ শেফচোভিচ ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লায়েন স্কটল্যান্ডের একটি গোলফ কোর্সে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠক করেন। প্রথমেই ট্রাম্প ৩০ শতাংশ শুল্কে অনড় ছিলেন; টানা আলোচনার পর তা ১৫ শতাংশে নামানো সম্ভব হয়। শেফচোভিচের ভাষায়, ‘আগের পৃথিবীটি ২ এপ্রিলের পর আর নেই—আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছে।’
সমালোচনা ও হতাশা
ফরাসি ও বেলজিয়ান রাজনীতিবিদেরা চুক্তিকে ‘অসম’, ‘অপমান’ বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে মনে করছেন, এত বড় অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও ইইউ আশাতীত ফল আনতে পারেনি। তবু লন্ডনের সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান রিফর্মের গবেষক আসলাক বর্গের মতে, ‘চুক্তিটি আদর্শ নয়, তবু যদি কার্যকর থাকে, পূর্বানুমেয় একটা পরিবেশ তৈরি করবে।’
কী পেল এবং কী ছাড়ল ইউরোপ
- • রক্ষা পেল: ডিজিটাল ব্যবসার উপর কড়া বিধি-নিষেধ, সংবেদনশীল মাংসপণ্য আমদানি নিষেধাজ্ঞা
- • ছেড়ে দিল: গাড়ি ও শিল্পপণ্যে পারস্পরিক শূন্য শুল্কের স্বপ্ন, অধিকাংশ রপ্তানিতে কম শুল্কের লক্ষ্য
- • প্রত্যাশিত ছিল: রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে মার্কিন জ্বালানি আমদানি—চুক্তি না হলেও যা আংশিক ঘটতই
নিরাপত্তা ও ভূ-কৌশলগত সমীকরণ
শুধু বাণিজ্য নয়; নিরাপত্তা, ইউক্রেন-সংঘাত ও ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা বজায় রাখাও আলোচনার অন্তর্গত ছিল। ইউরোপ চায়, রাশিয়ার আগ্রাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র যেন পাশে থাকে, অথচ ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপকে নিজস্ব সামরিক ব্যয় বাড়াতে চাপ দিয়ে চলেছে।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
১ আগস্ট থেকে ৩০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। নতুন চুক্তি সেই বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ৯৩ বিলিয়ন ইউরোর পাল্টা শুল্ক তালিকাও স্থগিত হবে। তবে অনেক খুঁটিনাটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি; বড় প্রশ্ন—এই সমঝোতা কত দিন টিকে থাকবে?
যুদ্ধ নয়, আপস
ইইউ বাণিজ্যকমিশনারের ভাষায়, ‘বাণিজ্যযুদ্ধ আকর্ষণীয় শোনাতে পারে, কিন্তু তার খেসারত কঠিন।’ নতুন চুক্তি আপাতত কাজ ও বাণিজ্য প্রবাহ বাঁচিয়ে রেখেছে, ইউরোপ-আমেরিকা সম্পর্কের নতুন অধ্যায় খুলেছে—যদিও সেটি যে উজ্জ্বল হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।