০৩:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫

পপ সম্রাট আজম খানের জীবন ও সুরের বিপ্লব

শৈশব ও বেড়ে ওঠা: এক দুর্দান্ত যাত্রার শুরু

বাংলাদেশের পপ সঙ্গীতের পথিকৃৎ আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে। তার আসল নাম ছিল মাহবুবুল হক খান। বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা জাহেদা খানম গৃহিণী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আজম খান ছিলেন চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ছিল সঙ্গীত ও স্বাধীনতার প্রতি অদম্য আকর্ষণ।

আজিমপুর গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারেই তার শৈশব কেটেছে। পল্টন এলাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশোনার চেয়ে সঙ্গীতেই বেশি মনোযোগ ছিল তার।

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আজম খান ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি “খালেদ মোশাররফের গেরিলা বাহিনীতে” ছিলেন এবং ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দেশপ্রেমের চেতনাকে সুরে সুরে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন।

প্রথম মঞ্চে ওঠা ও পপ সংগীতের জন্ম

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ‘উচ্চারণ’ নামের একটি ব্যান্ড গঠন করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ব্যান্ডগুলির অন্যতম। এই ব্যান্ডের মাধ্যমেই তিনি দেশের সঙ্গীত অঙ্গনে নতুন এক ধারা নিয়ে আসেন। পশ্চিমা রক ও পপ সঙ্গীতের ছোঁয়া এনে বাংলা গানে আধুনিকতার বিকাশ ঘটান।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথমবার লাইভ পারফর্ম করেন। সেদিনের গান ছিল—“রেল লাইনের ওই বস্তিতে”, যা মুহূর্তেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তার কণ্ঠের বিদ্রোহী ধারা, সহজবোধ্য কথা ও সুরের আবেগ সাধারণ মানুষকে ছুঁয়ে যায়।

জনপ্রিয় গানসমূহ: যেগুলো বদলে দিয়েছিল বাংলা গানের ভাষা

আজম খানের উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • রেল লাইনের ওই বস্তিতে
  • আলাল ও দুলাল
  • বাংলাদেশ
  • জিঞ্জিরা
  • অঞ্জনা
  • চুপ চুপ চুপ
  • সালেকা মালেকা
  • পাপড়ি

তাঁর গানের ভাষা ছিল স্পষ্ট, সহজ ও তরুণদের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো। তিনি তরুণ প্রজন্মের বেদনা, প্রেম, প্রতিবাদ ও আশা গানেই তুলে ধরতেন।

পারিবারিক জীবন: এক নীরব ভালোবাসা

আজম খান তার ব্যক্তিগত জীবন বরাবরই প্রচারের আলো থেকে দূরে রেখেছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন শেহনাজ খান। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল শান্ত ও সাধারণ। এই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে—দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। পরিবারের প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা, যা তিনি গোপন রাখতেই পছন্দ করতেন।

সামাজিক কাজ ও তরুণদের অনুপ্রেরণা

গান ছাড়াও আজম খান ছিলেন সমাজ সচেতন। তরুণদের নেশা থেকে দূরে রাখতে তিনি সচেতনতামূলক গান করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। অনেক সময় চ্যারিটি কনসার্ট করেছেন অসহায় মানুষের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশপ্রেম তার গানের প্রতিটি লাইনে প্রকাশ পেয়েছে।

রোগ, মৃত্যু ও অমরত্ব

২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আজম খান মুখগহ্বরের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। আজম খানের মৃত্যুর পরও তার গান বেঁচে আছে বাংলার ঘরে ঘরে।

আজম খানের প্রভাব ও উত্তরাধিকার

বাংলাদেশের ব্যান্ড ও আধুনিক সংগীতের ভিত্তি স্থাপন করেন আজম খান। তাকে ছাড়া বাংলাদেশের পপ ও রক মিউজিকের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। নগর বাউল, জেমস; লাকী আখান্দ, হাসান, বাপ্পা মজুমদার, আইয়ুব বাচ্চু প্রমুখ শিল্পীরা আজম খানকে তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন আন্দোলনের কণ্ঠস্বর। ছিলেন সুরের বিপ্লবের অগ্রদূত, যিনি গানের মাধ্যমে তরুণদের একত্র করেছিলেন দেশপ্রেম ও সচেতনতার মঞ্চে।

ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান

আজম খান ছিলেন গানের ‘আনন্দলোকের যোদ্ধা’। তিনি গানে গানে আমাদের সাহস দিয়েছেন, প্রেমের কথা বলেছেন, প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়েছেন। আজও তার গান মঞ্চে বাজলে হৃদয় কেঁপে ওঠে, চোখে জল আসে। তিনি নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি আজও অনুরণন তোলে বাঙালির হৃদয়ে।

আজম খান, আপনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন—বাংলাদেশের পপ সংগীতের রাজা হিসেবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

পপ সম্রাট আজম খানের জীবন ও সুরের বিপ্লব

০৪:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

শৈশব ও বেড়ে ওঠা: এক দুর্দান্ত যাত্রার শুরু

বাংলাদেশের পপ সঙ্গীতের পথিকৃৎ আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে। তার আসল নাম ছিল মাহবুবুল হক খান। বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা জাহেদা খানম গৃহিণী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আজম খান ছিলেন চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ছিল সঙ্গীত ও স্বাধীনতার প্রতি অদম্য আকর্ষণ।

আজিমপুর গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারেই তার শৈশব কেটেছে। পল্টন এলাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশোনার চেয়ে সঙ্গীতেই বেশি মনোযোগ ছিল তার।

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আজম খান ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি “খালেদ মোশাররফের গেরিলা বাহিনীতে” ছিলেন এবং ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দেশপ্রেমের চেতনাকে সুরে সুরে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন।

প্রথম মঞ্চে ওঠা ও পপ সংগীতের জন্ম

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ‘উচ্চারণ’ নামের একটি ব্যান্ড গঠন করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ব্যান্ডগুলির অন্যতম। এই ব্যান্ডের মাধ্যমেই তিনি দেশের সঙ্গীত অঙ্গনে নতুন এক ধারা নিয়ে আসেন। পশ্চিমা রক ও পপ সঙ্গীতের ছোঁয়া এনে বাংলা গানে আধুনিকতার বিকাশ ঘটান।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথমবার লাইভ পারফর্ম করেন। সেদিনের গান ছিল—“রেল লাইনের ওই বস্তিতে”, যা মুহূর্তেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তার কণ্ঠের বিদ্রোহী ধারা, সহজবোধ্য কথা ও সুরের আবেগ সাধারণ মানুষকে ছুঁয়ে যায়।

জনপ্রিয় গানসমূহ: যেগুলো বদলে দিয়েছিল বাংলা গানের ভাষা

আজম খানের উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • রেল লাইনের ওই বস্তিতে
  • আলাল ও দুলাল
  • বাংলাদেশ
  • জিঞ্জিরা
  • অঞ্জনা
  • চুপ চুপ চুপ
  • সালেকা মালেকা
  • পাপড়ি

তাঁর গানের ভাষা ছিল স্পষ্ট, সহজ ও তরুণদের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো। তিনি তরুণ প্রজন্মের বেদনা, প্রেম, প্রতিবাদ ও আশা গানেই তুলে ধরতেন।

পারিবারিক জীবন: এক নীরব ভালোবাসা

আজম খান তার ব্যক্তিগত জীবন বরাবরই প্রচারের আলো থেকে দূরে রেখেছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন শেহনাজ খান। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল শান্ত ও সাধারণ। এই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে—দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। পরিবারের প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা, যা তিনি গোপন রাখতেই পছন্দ করতেন।

সামাজিক কাজ ও তরুণদের অনুপ্রেরণা

গান ছাড়াও আজম খান ছিলেন সমাজ সচেতন। তরুণদের নেশা থেকে দূরে রাখতে তিনি সচেতনতামূলক গান করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। অনেক সময় চ্যারিটি কনসার্ট করেছেন অসহায় মানুষের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশপ্রেম তার গানের প্রতিটি লাইনে প্রকাশ পেয়েছে।

রোগ, মৃত্যু ও অমরত্ব

২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আজম খান মুখগহ্বরের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। আজম খানের মৃত্যুর পরও তার গান বেঁচে আছে বাংলার ঘরে ঘরে।

আজম খানের প্রভাব ও উত্তরাধিকার

বাংলাদেশের ব্যান্ড ও আধুনিক সংগীতের ভিত্তি স্থাপন করেন আজম খান। তাকে ছাড়া বাংলাদেশের পপ ও রক মিউজিকের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। নগর বাউল, জেমস; লাকী আখান্দ, হাসান, বাপ্পা মজুমদার, আইয়ুব বাচ্চু প্রমুখ শিল্পীরা আজম খানকে তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন আন্দোলনের কণ্ঠস্বর। ছিলেন সুরের বিপ্লবের অগ্রদূত, যিনি গানের মাধ্যমে তরুণদের একত্র করেছিলেন দেশপ্রেম ও সচেতনতার মঞ্চে।

ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান

আজম খান ছিলেন গানের ‘আনন্দলোকের যোদ্ধা’। তিনি গানে গানে আমাদের সাহস দিয়েছেন, প্রেমের কথা বলেছেন, প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়েছেন। আজও তার গান মঞ্চে বাজলে হৃদয় কেঁপে ওঠে, চোখে জল আসে। তিনি নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি আজও অনুরণন তোলে বাঙালির হৃদয়ে।

আজম খান, আপনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন—বাংলাদেশের পপ সংগীতের রাজা হিসেবে।