শৈশব ও জন্মস্থান
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের এক অবিস্মরণীয় নাম এ.টি.এম. শামসুজ্জামান। পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, নোয়াখালী জেলার দৌলতপুর গ্রামে। তবে শৈশব থেকেই বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকার নবাবপুর এলাকায়। তার বাবা কাজী নুরুজ্জামান ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী এবং মা রওশন আরা ছিলেন একজন গৃহিণী। পরিবারে ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা। তার বাবা ছিলেন একজন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ, যিনি বাড়িতে প্রায়ই নাটক, গান ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। এসব কিছুই ছোটবেলা থেকেই শামসুজ্জামানকে তৈরি করেছিল একজন সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে। পড়াশোনা শুরু করেন ঢাকার পোগোজ স্কুলে, পরে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল এবং আরও পরে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) পড়াশোনা করেন। যদিও শিক্ষাজীবন খুব দীর্ঘ ছিল না, তবে অভিনয় ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ ছিল বরাবরই প্রবল।
অভিনয় জীবনের সূচনা
এ.টি.এম. শামসুজ্জামানের কর্মজীবনের শুরু হয় ষাটের দশকে সহকারী পরিচালক হিসেবে। চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের সহকারী হিসেবে কাজ করেই তিনি এই মাধ্যমে প্রবেশ করেন। সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি অভিনয়ের প্রতি দুর্নিবার টান অনুভব করেন। তার প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র ছিল ‘নয়নমণি’ (১৯৭৬), যেখানে তিনি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
খল চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেন বাংলা চলচ্চিত্রে। তার চরিত্রগুলো ছিল বাস্তবধর্মী, প্রাণবন্ত এবং দর্শকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলার মতো। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘বেহুলা’, ‘দহন’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘এই তো জীবন’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে তার পারফরম্যান্স আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। অভিনয়ে তার বহুমাত্রিকতা ছিল বিস্ময়কর। কখনো নিষ্ঠুর খলনায়ক, কখনো হাস্যকর চরিত্রে, আবার কখনো সহানুভূতিশীল পিতার ভূমিকায়—সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ ও বিশ্বস্ত।
নাটক ও টেলিভিশনে অবদান
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি এ.টি.এম. শামসুজ্জামান নাটক ও টেলিভিশনেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আশি ও নব্বই দশকে টিভি নাটকের স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান মুখ। বিখ্যাত নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মুনির চৌধুরীর নাটকে তার উপস্থিতি নাট্যজগতকে সমৃদ্ধ করেছে।
তার অভিনীত কিছু জনপ্রিয় নাটক হলো — ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মাটির ময়না’, ‘বকুলপুরে যাত্রী’ ইত্যাদি। তার সংলাপ বলার ধরন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত। এই নাটকগুলোর মাধ্যমে তিনি দর্শকদের শুধু বিনোদনই দেননি, বরং জীবনের নানা বাস্তবতা, রূঢ়তা ও হাস্যরসকে মিশিয়ে গভীর জীবনবোধ উপস্থাপন করেছেন।
বিশেষত হুমায়ূন আহমেদের নাটকে তার চরিত্রগুলো আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। যেমন ‘আজ রবিবার’ নাটকে রশিদ চরিত্রে তিনি যেমন ছিলেন প্রাণবন্ত, তেমনি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে ব্যতিক্রমী পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে মুগ্ধ করেছিলেন দর্শককে।
পারিবারিক জীবন
এ.টি.এম. শামসুজ্জামান বিবাহিত ছিলেন এবং তার স্ত্রী হাসিনা শামসুজ্জামান ছিলেন তার জীবনের শক্তি ও সঙ্গী। তারা একসাথে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। এই দম্পতির পাঁচ সন্তান ছিল — তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে। তার সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ পেশাগতভাবে মিডিয়া ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও কেউই সরাসরি অভিনয় পেশায় প্রবেশ করেননি।
তার পারিবারিক জীবন ছিল শান্তিপূর্ণ ও গুছানো। তিনি পরিবারের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন এবং অভিনয় জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারের জন্য সময় বের করতেন। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে তার নিজ বাসভবনে কাটিয়েছেন, যেখানে এক সময় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিমনাদের আড্ডার কেন্দ্র ছিল।
পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলাদেশের বিনোদনজগতে এ.টি.এম. শামসুজ্জামানের অবদান অনন্য ও প্রশংসনীয়। তার প্রতিভা ও কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
- • জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার:তিনি মোট ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। তার মধ্যে ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘দহন’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘মাটির ময়না’ প্রভৃতি ছবিতে সেরা পার্শ্বচরিত্রে এবং সেরা কৌতুক অভিনেতার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন।
- • একুশে পদক:২০১৫ সালে তিনি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন, যা ছিল তার জীবনের এক গর্বিত মুহূর্ত।
- • বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডসহ বহু সংগঠন তাকে সম্মানিত করেছে।
জীবনের শেষ অধ্যায় ও মৃত্যুবরণ
২০১৮ সালের পর থেকে এ.টি.এম. শামসুজ্জামানের শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে যেতে থাকে। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা, কিডনি সমস্যা ও অস্ত্রোপচারের কারণে তাকে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তবে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানসিকভাবে দৃঢ় ও আশাবাদী ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও তার চোখে মুখে ছিল জীবনের প্রতি ভালোবাসা।
২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঢাকার সূত্রাপুরের নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮০ বছর। পরে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
এ.টি.এম. শামসুজ্জামান কেবল একজন শিল্পী নন, ছিলেন একজন জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন সেই ক’জন অভিনয়শিল্পীর একজন যাদের কর্মজীবন ও ব্যক্তিত্ব নতুন প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শক। তার সংলাপ, সংযত অভিনয়, অভিব্যক্তির গভীরতা এবং চরিত্রের বিশ্লেষণ সবকিছুই ছিল শিক্ষণীয়। নবীন ও প্রবীণ শিল্পীরা তাকে অনুসরণ করতেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটকের ইতিহাসে তার অবস্থান একটি মাইলফলক। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে প্রতিভা ও নিষ্ঠা থাকলে, একজন শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন কালজয়ী। তার অবদান শুধু এক প্রজন্মের নয়, বরং পরবর্তী বহু প্রজন্ম তাকে মনে রাখবে শ্রদ্ধার সঙ্গে।
শূন্যতা
বাংলাদেশের বিনোদনজগতে এ.টি.এম. শামসুজ্জামানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অভিনয়ে তার দক্ষতা, জীবনবোধ, মানবিকতা এবং সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা কখনোই পূরণ হবার নয়। তবে তার রেখে যাওয়া অসাধারণ কাজ, সংলাপ, এবং চরিত্রগুলো তাকে চিরজীবী করে রাখবে। একজন শিল্পীর জীবনের চেয়েও বড় অর্জন — মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া — সেই কাজটি তিনি অনায়াসেই করেছেন।