এক দশকের সম্পর্কের হঠাৎ ইতি
রাজধানীর গুলশান এলাকার একটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে দশ বছর ধরে গৃহকর্মীর কাজ করতেন মনোয়ারা বেগম। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কোঠায়। ঘরের সবার জন্য নির্ভরতার নাম হয়ে উঠেছিলেন তিনি—বাচ্চার দেখাশোনা, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, অসুস্থতায় ওষুধ এনে দেওয়া—সব কিছুই করতেন নিঃশব্দ দক্ষতায়। গৃহস্বামী-গৃহিণীর কাছে ‘আপা’ নামেই পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝি হঠাৎ করেই গৃহকর্ত্রী জানিয়ে দিলেন, “আপা, আমাদের আর রাখা সম্ভব না। পারিবারিক খরচ কমাতে হচ্ছে।”
এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান মনোয়ারা। তার কণ্ঠে তখনও অবিশ্বাস—“দশ বছর ধরে যে সম্পর্ক, সে কি এত সহজে ছিন্ন হয়ে যেতে পারে?”
অর্থনীতির টানাপোড়েন: মধ্যবিত্তের সংকোচন, প্রান্তিকের বিপর্যয়
বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থা দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় গৃহস্থালি ব্যয়ের লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলো। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় যে পরিবারগুলো আগেও কিছুটা স্বচ্ছল ছিল, তারাও আজ অনিরাপদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রুহুল আমিন বলেন, “প্রথম যে খরচটা কাটা পড়ে, তা হচ্ছে ‘সহযোগিতানির্ভর খরচ’—যেমন গৃহকর্মী, ড্রাইভার, টিউটর। এর ফলে যেসব প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ এ খাতে নির্ভরশীল, তারা সরাসরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।”
মনোয়ারার কথায়, “আগে ওনারা দুইজন গৃহকর্মী রাখতেন। এখন বলছেন, কারোই রাখা সম্ভব না। বাসাভাড়া, বাচ্চার স্কুল ফি—সবই নাকি বেড়ে গেছে। নিজেরাও টিকতে পারছেন না।”
মানসিক বিপর্যয়ের অভিঘাত
মনোয়ারার স্বামী মারা যান প্রায় এক দশক আগে। তিন সন্তান নিয়ে কোনো রকমে জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তার রোজগারই ছিল একমাত্র ভরসা। কাজ হারানোর পর শুরু হয় মানসিক চাপ, অনিদ্রা, উদ্বেগ।
“আমি সকালে না বের হলে যেন দম আটকে আসে। বাচ্চাদের সামনে কিছু বুঝতে দিই না, কিন্তু রাতে ঘুম আসে না,”—বলেন তিনি।
মনোচিকিৎসক ডা. নিশাত ইসলাম বলেন, “আকস্মিক আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া মানসিকভাবে মানুষের আত্মপরিচয়ে আঘাত করে। বিশেষ করে যাদের জীবনযাত্রায় ধারাবাহিকতা ছিল, তাদের কাছে এই ধাক্কা অনেক বড়।”

কাজ নেই, ব্যয় বাড়ছে: এক অসম যুদ্ধ
ছেলে-মেয়ের স্কুল ফি, বাসাভাড়া, খাবার খরচ—কোনোটাই ঠিকমতো সামলাতে পারছেন না মনোয়ারা। আত্মীয়দের কাছ থেকে কিছু ধার নিয়েছেন, কিন্তু তাও সীমিত। কয়েকটি বাসায় গিয়েও কাজ পাননি। কেউ নিচ্ছেন না, কেউ কম বেতনে নতুন কাউকে নিয়েছেন।
“আগে আট থেকে নয় হাজার টাকা পেতাম, এখন শুনছি পাঁচ-ছয় হাজারেই লোক পাওয়া যাচ্ছে। আমি কি এই বয়সে এত কম টাকায় চালাতে পারি?”
এই সমস্যাটি শুধু মনোয়ারার নয়। নারায়ণগঞ্জ গৃহকর্মী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শিউলি বেগম বলেন, “গত এক বছরে অন্তত ৩০ শতাংশ গৃহকর্মী কাজ হারিয়েছেন। অধিকাংশের বয়স ৪০ বছরের বেশি। তারা আর কাজ পাচ্ছেন না, আবার সরকারি কোনো সহায়তা বা সামাজিক নিরাপত্তার আওতাতেও পড়েন না।”
“ইচ্ছা থাকলে কাজ হয়”: দৃঢ় প্রতিজ্ঞা
তবু মনোয়ারা হাল ছাড়েননি। প্রতিদিন নতুন করে চেষ্টা করছেন। “আমি জানি, একদিন না একদিন কিছু একটা হবেই। বাসা পরিষ্কারের কাজ হলেও করব। মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হতে দেব না।”
এই ইচ্ছাশক্তিই তাকে এগিয়ে নিচ্ছে, যদিও বাস্তবতা কঠিন। তার মতো হাজার হাজার নারী এখন বেকার—কারও স্বামী নেই, কারও সন্তান ছোট, কারও বয়স বেশি হয়ে গেছে। তাদের না আছে সঞ্চয়, না আছে আশ্রয়।

নীরব এই সংগ্রামের খবর কেউ রাখে না
মনোয়ারাদের গল্প বড় কোনো ব্রেকিং নিউজ হয় না। তাদের কথা নেই টকশোতে, নেই জাতীয় পরিকল্পনায়। অথচ তারাই সমাজের সবচেয়ে পরিশ্রমী ও নির্ভরযোগ্য অংশ।
বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ গৃহকর্মী রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ নারী। তাদের জন্য নেই শ্রমিক আইন, নেই স্বাস্থ্যসেবা, নেই বেকার ভাতা। অথচ তারাই কাজ করেন দৈনিক দশ থেকে বারো ঘণ্টা, কোনো ছুটি বা নিরাপত্তা ছাড়া।
সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত কোনো জরুরি পুনর্বাসন পরিকল্পনা বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গৃহকর্মীদের জন্য চালু হয়নি।
সংকটের গভীরে যে সমাজ
মনোয়ারা বেগমের চাকরি হারানো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি দেশের অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। যখন টাকার অভাবে একজন গৃহকর্মী চাকরি হারান, তখন শুধু একটি পরিবার নয়—একটি সমাজের দায়িত্ববোধ, ন্যায়ের বোধ ও সহানুভূতির মানদণ্ডও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এখনই সময় রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে, কীভাবে এই পরিশ্রমী ও প্রান্তিক মানুষের জীবনকে সুরক্ষা দেওয়া যায়। যাতে একদিন তারা কেবল দুর্ভোগের গল্প না হয়ে ওঠে—বরং টিকে থাকার সাহসী প্রতিমূর্তি হয়ে থাকেন আমাদের মাঝে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















