মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের রুশ তেল কেনা নিয়ে সাম্প্রতিক ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশটির রপ্তানি পণ্যের ওপর উচ্চ “দ্বিতীয়িক শুল্ক” আরোপের হুমকি দিয়েছেন, যা ন্যায়-পরায়ণতার সব মানদণ্ড ও বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৬ আগস্ট এই হুমকিই বাস্তবে পরিণত হয়, যখন ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে মোট হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করেন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করতে গিয়ে ট্রাম্প যে যুক্তি তুলে ধরছেন, তা গত তিন বছর ধরে পশ্চিমা ইউরোপীয় নেতারাও বারবার ব্যবহার করেছেন—ভারত নাকি রুশ যুদ্ধযন্ত্রের অর্থ জোগাচ্ছে। কিন্তু একই ভুল বক্তব্য বারবার উচ্চারণ করলেই তা সত্য হয় না, বিশেষ করে যখন তাতে ভ্রান্ত তথ্য, দুর্বল যুক্তি ও দ্বৈত মানদণ্ড বিদ্যমান থাকে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জি-৭ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর ব্যাপক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এবং তেলসহ নানা পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করলে বৈশ্বিক তেলসরবরাহে ধস ও মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হয়। সে সময় রাশিয়া প্রতিদিন প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত ও পরিশোধিত জ্বালানি রপ্তানি করত, যা বিশ্ব-ভোগের প্রায় ৭.৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৪ মিলিয়ন ব্যারেল যেত ইইউ-তে, যা এক বছরের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

বৈশ্বিক ঘাটতি এড়াতে তখন নিষেধাজ্ঞায় অংশ না নেওয়া দেশগুলোকে রুশ তেল আমদানি করতে হতো। দীর্ঘদিনের ক্রেতা চীন ২০২৪-এ সমুদ্রপথে আমদানি প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিনে প্রায় ৭ লাখ ১৫ হাজার ব্যারেল থেকে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেলে পৌঁছায়। তবে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ভারতের ক্ষেত্রে: ২০২১ সালের আগে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি আমদানির জায়গা থেকে ২০২৪-এ রুশ অপরিশোধিত তেল ক্রয় বেড়ে দৈনিক ১৬ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেলে পৌঁছায়, যা ভারতের মোট আমদানির প্রায় ৩৫ শতাংশ।
চীন ও ভারতের এই বাড়তি আমদানি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশের তেল ইইউ-র শোধনাগারগুলোতে যেতে পারে, যাদের বিকল্প উৎস সীমিত হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, দাম কমে আসে। রুশ তেল বিকল্প পথে যাওয়ায় ব্রেন্ট ক্রুডের দর ২০২২-এর মার্চের প্রথম দিকে ব্যারেল-প্রতি ১২৮ ডলার ছুঁয়ে সেই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৮০ ডলারের ঘরে নেমে আসে।
ট্রাম্পের দাবি যে যুক্তরাষ্ট্রের শেল তেল উৎপাদকরা সহজেই রুশ তেলের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে, তা ভ্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল উৎপাদন বর্তমানে রেকর্ড ১ কোটি ৩৫ লাখ ব্যারেল হলেও শেল অঞ্চলগুলোর খনন ও উৎপাদন স্থবির হচ্ছে, বিনিয়োগও কমছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ৯১ শতাংশ রপ্তানি হালকা গ্রেডের, যা রাশিয়ার মাঝারি ও ভারী গ্রেডের জায়গা পূরণে উপযুক্ত নয়।

ভারতকে একা দোষারোপ করাও অবিচার; চীন ও তুরস্কসহ অন্তত ছয়টি দেশ নিয়মিত রুশ অপরিশোধিত তেল কিনছে, যার বৈদেশিক রপ্তানি এ বছর গড়ে ৪২ লাখ ব্যারেল প্রতিদিন। পাশাপাশি ভারত, চীন ও তুরস্ক মিলে প্রতিদিন প্রায় ২৪ লাখ ব্যারেল রুশ পরিশোধিত পণ্য আমদানি করে; হঠাৎ এসব সরবরাহ বন্ধ হলে পরিশোধন-সক্ষমতা সীমিত বিশ্ববাজার মারাত্মক অস্থির হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় দেশগুলো এখনও রাশিয়া থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস, সার, ধাতু, রাসায়নিক ও পরমাণু উপকরণসহ বিপুল পণ্য আমদানি করছে—যার রাজস্বও তো একই রুশ কোষাগারে জমা হচ্ছে! এই বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে ট্রাম্প আবার অভিযোগ তোলেন, ভারত রুশ তেল থেকে তৈরি জ্বালানি ইউরোপে রপ্তানি করে ‘বড় মুনাফা’ করছে। আসলে ভারত অপরিশোধিত তেল পুনরায় বিক্রি করে না; রুশ তেলের ছাড়ে কাঁচামাল সস্তা হলেও ভারতীয় শোধনাগারের লাভ যুক্তরাষ্ট্রের গালফ কোস্টের শোধনাগারগুলোর তুলনায় কম। ভারতের তৈরি জ্বালানির বেশিরভাগই দেশেই ব্যবহার হয়; রপ্তানি ২০২২-এর মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রতিদিন ১২.৮ লাখ ব্যারেল থেকে ২০২৫-এর মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে মাত্র ১৩.৩ লাখ ব্যারেলে পৌঁছেছে।
তাহলে ট্রাম্পের রাগের কারণ কী? সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনায়—বিশেষ করে কৃষি-খাতে—দিল্লি আপসহীন থাকাতেই তিনি ক্ষুব্ধ। এখন শুল্ক বাস্তবায়িত হওয়ায় উত্তেজনা ও তেলবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পুতিনের সঙ্গে বৈঠক সামনে রেখে ট্রাম্পের উচিত ইউক্রেন সংকটে কূটনৈতিক সমাধানে মনোযোগ দেওয়া—ভারত বা অন্য দেশগুলোকে জ্বালানি-রাজনীতির বিপজ্জনক খেলায় ‘দাবা-ঘুঁটি’তে রূপান্তর না করে।
ভান্দানা হরি 


















