০৬:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল মাইক্রোসফট ও জি৪২ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডেটা-সেন্টার বিস্তার ঘোষণা বড় টেকের চাপের মুখে ইইউ এইআই আইন বাস্তবায়ন বিলম্বে বিবেচনায় বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে গম কিনছে, বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে বড় পদক্ষেপ ব্লেক লাইভলির মামলায় সাক্ষী টেইলর সুইফট ও হিউ জ্যাকম্যান; ক্ষতিপূরণের দাবি ১৬১ মিলিয়ন ডলার ডাক রাশ্মিকার ‘দ্য গার্লফ্রেন্ড’ প্রথম দিনেই ব্যর্থতার মুখে ৩ দফা দাবি: শহীদ মিনারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি গাজীপুরে তুলার গুদামে আগুন নিয়ন্ত্রণে সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রাল চার্চে বিস্ফোরণ: তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ

ফ্রান্সের বিষাক্ত রান্নাঘর সংস্কৃতি: এক শতাব্দীর উত্তরাধিকার ভাঙার লড়াই

এক বিতর্কিত সাফল্যের আড়াল

ফ্রান্সে মিশেলিন গাইডের তারকা রেস্তোরাঁর তালিকা প্রকাশের পর সাংবাদিক নোরা বোয়াজুনি নিয়মিত ক্ষুব্ধ বার্তা পান। এসব বার্তা আসে এমন রেস্তোরাঁ কর্মীদের কাছ থেকে, যাদের জীবনে নরকস্বরূপ পরিবেশ তৈরি করা সহিংস ও অপমানজনক শেফরা আবারও পুরস্কার ও সম্মান পাচ্ছেন। ২০১৭ সাল থেকে বোয়াজুনি ফ্রান্সের রান্নাঘরে প্রচলিত বিষাক্ত সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিবেদন করছেন, তবে তার সাম্প্রতিক বই “ভায়োলেন্স ইন দ্য কিচেন” (২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত) এই সমস্যার গভীরতা জনসমক্ষে উন্মোচন করেছে।

বইয়ের সাক্ষ্য: সহিংসতা, বর্ণবাদ ও যৌন হয়রানি

২০২০ সাল থেকে সংগৃহীত সাক্ষ্যগুলোতে উঠে এসেছে—শেফদের সহিংস আচরণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কর্মীদের পোড়ানো, প্যান ছুঁড়ে মারা, বর্ণবাদী হয়রানি, নারী কর্মীদের দৈনিক যৌন ইঙ্গিত ও শারীরিক স্পর্শ, এমনকি এক সহকর্মীর দ্বারা ওয়াক-ইন কুলারে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ। বোয়াজুনির মতে, রান্নাঘরে মানুষকে ‘মানবিক মর্যাদা’ থেকে বঞ্চিত করেই তাদের শোষণ সহজ হয়।

ঐতিহাসিক কাঠামো: সামরিক ধাঁচের ‘ব্রিগেড সিস্টেম’

ফরাসি শেফ অগাস্ট এসকোফিয়ের ১৯শ শতকের শেষ দিকে তৈরি করা ‘কিচেন ব্রিগেড’ ব্যবস্থা সামরিক শৃঙ্খলা অনুসরণ করে—শীর্ষে শেফ দ্য কুইজিন ও সু-শেফ, তার নিচে বিভিন্ন স্টেশনের দায়িত্বে থাকা শেফ দ্য পার্টি, তারপর জুনিয়র কুক ও শিক্ষানবিশ। এই কাঠামো দক্ষতা বাড়ালেও অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ দেয়। বিদেশি শেফরা ফ্রান্সে শিখে নিজ দেশে এই ধাঁচ নিয়ে যান, ফলে বিষাক্ত সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

সমাধানের প্রস্তাব: উন্মুক্ত রান্নাঘর ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ

কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১ সালের এক গবেষণা জানায়, গোপন ও বিচ্ছিন্ন ফাইন ডাইনিং রান্নাঘর সহিংসতা ও হয়রানির ঝুঁকি বাড়ায়। সমাধান হতে পারে উন্মুক্ত রান্নাঘর, যেখানে জনসম্মুখে কাজ হয়। ফরাসি রেস্তোরাঁ শিল্প সংগঠনের প্রেসিডেন্ট থিয়েরি মার্ক্স মনে করেন, ব্রিগেড সিস্টেম চাপের পরিবেশে কার্যকর হলেও সেরা শেফরা সবসময় ভালো নেতা হন না—তাদের জন্য ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: #মিটু আন্দোলন ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিরোধ

গত পাঁচ বছরে #মিটু আন্দোলন ও তরুণ প্রজন্মের দৃঢ় মনোভাব ফ্রান্সে নিরাপদ রান্নাঘরের দাবি জোরদার করেছে। ২০২১ সালে নারী শেফদের প্রতিষ্ঠিত ‘বঁদির.ই’ সংগঠন সহিংসতা প্রতিরোধ কর্মশালা শুরু করেছে, বিশেষ করে ১৫ বছর বয়সেই পেশাগত বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য, যাতে তারা সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে না করে। সংগঠনটি ভুক্তভোগীদের জন্য হেল্পলাইন, যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণও চালু করেছে।

নতুন উদাহরণ: নারী নেতৃত্বাধীন মিশেলিন-তারকাখচিত রেস্তোরাঁ

৩৪ বছর বয়সী শেফ মানোঁ ফ্লুরি প্যারিসে তার রেস্তোরাঁ ‘দাতিল’ প্রতিষ্ঠা করে সপ্তাহান্তে বন্ধ রাখেন, পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন, নিয়মিত ব্রিফিং ও ব্যক্তিগত আলোচনার ব্যবস্থা রাখেন, এবং সমস্ত ব্যবস্থাপনা পদে নারী নিয়োগ দেন। তার লক্ষ্য—প্রমাণ করা যে নারীরাও শীর্ষ নেতৃত্বে সফল হতে পারেন।

পরিবর্তনের দাবি

থিয়েরি মার্ক্সের মতে, সময় বদলেছে—কর্মীরা এখন বেশি ক্ষমতাশালী ও সচেতন। খারাপ ব্যবস্থাপনা, দুর্বলদের ওপর দমন আর কার্যকর নয়। ফ্রান্সের রান্নাঘর সংস্কৃতিতে নিরাপত্তা, সম্মান ও নেতৃত্বের নতুন মানদণ্ড প্রতিষ্ঠার এটাই উপযুক্ত সময়।

জনপ্রিয় সংবাদ

নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল

ফ্রান্সের বিষাক্ত রান্নাঘর সংস্কৃতি: এক শতাব্দীর উত্তরাধিকার ভাঙার লড়াই

১০:০০:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫

এক বিতর্কিত সাফল্যের আড়াল

ফ্রান্সে মিশেলিন গাইডের তারকা রেস্তোরাঁর তালিকা প্রকাশের পর সাংবাদিক নোরা বোয়াজুনি নিয়মিত ক্ষুব্ধ বার্তা পান। এসব বার্তা আসে এমন রেস্তোরাঁ কর্মীদের কাছ থেকে, যাদের জীবনে নরকস্বরূপ পরিবেশ তৈরি করা সহিংস ও অপমানজনক শেফরা আবারও পুরস্কার ও সম্মান পাচ্ছেন। ২০১৭ সাল থেকে বোয়াজুনি ফ্রান্সের রান্নাঘরে প্রচলিত বিষাক্ত সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিবেদন করছেন, তবে তার সাম্প্রতিক বই “ভায়োলেন্স ইন দ্য কিচেন” (২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত) এই সমস্যার গভীরতা জনসমক্ষে উন্মোচন করেছে।

বইয়ের সাক্ষ্য: সহিংসতা, বর্ণবাদ ও যৌন হয়রানি

২০২০ সাল থেকে সংগৃহীত সাক্ষ্যগুলোতে উঠে এসেছে—শেফদের সহিংস আচরণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কর্মীদের পোড়ানো, প্যান ছুঁড়ে মারা, বর্ণবাদী হয়রানি, নারী কর্মীদের দৈনিক যৌন ইঙ্গিত ও শারীরিক স্পর্শ, এমনকি এক সহকর্মীর দ্বারা ওয়াক-ইন কুলারে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ। বোয়াজুনির মতে, রান্নাঘরে মানুষকে ‘মানবিক মর্যাদা’ থেকে বঞ্চিত করেই তাদের শোষণ সহজ হয়।

ঐতিহাসিক কাঠামো: সামরিক ধাঁচের ‘ব্রিগেড সিস্টেম’

ফরাসি শেফ অগাস্ট এসকোফিয়ের ১৯শ শতকের শেষ দিকে তৈরি করা ‘কিচেন ব্রিগেড’ ব্যবস্থা সামরিক শৃঙ্খলা অনুসরণ করে—শীর্ষে শেফ দ্য কুইজিন ও সু-শেফ, তার নিচে বিভিন্ন স্টেশনের দায়িত্বে থাকা শেফ দ্য পার্টি, তারপর জুনিয়র কুক ও শিক্ষানবিশ। এই কাঠামো দক্ষতা বাড়ালেও অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ দেয়। বিদেশি শেফরা ফ্রান্সে শিখে নিজ দেশে এই ধাঁচ নিয়ে যান, ফলে বিষাক্ত সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

সমাধানের প্রস্তাব: উন্মুক্ত রান্নাঘর ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ

কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১ সালের এক গবেষণা জানায়, গোপন ও বিচ্ছিন্ন ফাইন ডাইনিং রান্নাঘর সহিংসতা ও হয়রানির ঝুঁকি বাড়ায়। সমাধান হতে পারে উন্মুক্ত রান্নাঘর, যেখানে জনসম্মুখে কাজ হয়। ফরাসি রেস্তোরাঁ শিল্প সংগঠনের প্রেসিডেন্ট থিয়েরি মার্ক্স মনে করেন, ব্রিগেড সিস্টেম চাপের পরিবেশে কার্যকর হলেও সেরা শেফরা সবসময় ভালো নেতা হন না—তাদের জন্য ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: #মিটু আন্দোলন ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিরোধ

গত পাঁচ বছরে #মিটু আন্দোলন ও তরুণ প্রজন্মের দৃঢ় মনোভাব ফ্রান্সে নিরাপদ রান্নাঘরের দাবি জোরদার করেছে। ২০২১ সালে নারী শেফদের প্রতিষ্ঠিত ‘বঁদির.ই’ সংগঠন সহিংসতা প্রতিরোধ কর্মশালা শুরু করেছে, বিশেষ করে ১৫ বছর বয়সেই পেশাগত বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য, যাতে তারা সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে না করে। সংগঠনটি ভুক্তভোগীদের জন্য হেল্পলাইন, যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণও চালু করেছে।

নতুন উদাহরণ: নারী নেতৃত্বাধীন মিশেলিন-তারকাখচিত রেস্তোরাঁ

৩৪ বছর বয়সী শেফ মানোঁ ফ্লুরি প্যারিসে তার রেস্তোরাঁ ‘দাতিল’ প্রতিষ্ঠা করে সপ্তাহান্তে বন্ধ রাখেন, পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন, নিয়মিত ব্রিফিং ও ব্যক্তিগত আলোচনার ব্যবস্থা রাখেন, এবং সমস্ত ব্যবস্থাপনা পদে নারী নিয়োগ দেন। তার লক্ষ্য—প্রমাণ করা যে নারীরাও শীর্ষ নেতৃত্বে সফল হতে পারেন।

পরিবর্তনের দাবি

থিয়েরি মার্ক্সের মতে, সময় বদলেছে—কর্মীরা এখন বেশি ক্ষমতাশালী ও সচেতন। খারাপ ব্যবস্থাপনা, দুর্বলদের ওপর দমন আর কার্যকর নয়। ফ্রান্সের রান্নাঘর সংস্কৃতিতে নিরাপত্তা, সম্মান ও নেতৃত্বের নতুন মানদণ্ড প্রতিষ্ঠার এটাই উপযুক্ত সময়।