০২:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১২)

  • Sarakhon Report
  • ১১:৩০:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫
  • 101

শরৎ-সন্নিধানে

শরৎচন্দ্রের সাহিত্য লইয়া আমাদের ফরিদপুর সাহিত্য-সভায় একদিন আলোচনা হইয়াছিল। তাহাতে আমি শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের বিষয়ে যে সকল কথা বলিয়াছিলাম, তাহার সঙ্গে অন্যান্য সভ্যের মোটেই মতের মিল ছিল না। যাঁহারা শরৎচন্দ্রকে বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি দাঁড় করান তাঁহাদের বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য এই ছিল যে, যুগ-প্রবর্তক সাহিত্যিকেরা আসেন প্রতিভার আলোকস্তম্ভ জ্বালাইয়া। দূর দূরান্তর হইতে কালের পথিকেরা সেই আলোকস্তম্ভদেখিতে পায়।

বঙ্কিমের সাহিত্যের প্রতি আমরা যখন লক্ষ করি তখন আমরা তাঁর ভাবে-ভাষায়-দৃষ্টিতে একেবারে এক সম্পূর্ণ অভিনব ব্যাপার দেখিতে পাই। ঈশ্বর গুপ্তের বা বিদ্যাসাগরের আমলে ইহা কেহই অনুমান করিতে পারিত না। তেমনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের আর এক নবীন জগতের সহিত আমরা পরিচিত হই। সকল সংস্কারের ঊর্ধ্বে দাঁড়াইয়া এরূপ ভাবে রস-বিতরণ বঙ্কিমের যুগে কেহই কল্পনা করিতে পারিত না। ভাবে, ভাষায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের জগৎ বঙ্কিমের জগৎ হইতে একেবারে পৃথক। সেইভাবে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম প্রভৃতি যুগ-প্রবর্তক সাহিত্য-স্রষ্টাদের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইঁহাদের একের জগৎ অপরের জগৎ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

শরৎচন্দ্রের সাহিত্য-প্রতিভাকে রবীন্দ্রনাথের সমপর্যায়ে ফেলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষার উপর দাঁড়াইয়াই শরৎচন্দ্র তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছেন। একমাত্র সামাজিক সমস্যা ছাড়া শরৎ-সাহিত্যে আর কোনো নূতন সমস্যা আলোচিত হয় নাই।

আমার এই কথার মধ্যে কতকটা যে বাড়াবাড়ি আছে, সে কথা আজ বুঝিতে পারিতেছি। শরৎচন্দ্র শরৎচন্দ্রই এবং রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই। গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য পদ্ম ফুলে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তাই বলিয়া পদ্ম ফুলের মূল্য কমিয়া যায় না। তাহা ছাড়া সাহিত্যের অভিনবত্ব দেখিয়াই সাহিত্য বিচার চলে না। তাহা যদি চলিত তবে ঈশ্বর গুপ্তও যুগ-প্রবর্তক সাহিত্যস্রষ্টা হইয়া রবীন্দ্রনাথের সমান আদর পাইতেন।

কিন্তু সেদিনকার সাহিত্য-সভায় আমার আলোচনা লইয়া এক তুমুল প্রতিবাদ চলে। সভায় সকলের মত ছিল, শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের চাইতে প্রতিভায় কোনো অংশে হীন তো নহেনই, বরঞ্চ কোনো কোনো বিষয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন। যেমন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের ঘরের কথা, সুখদুঃখের কথা। এই সভার খবর এসোসিয়েটেড প্রেসের মারফত কয়েকটি দৈনিক কাগজে ছাপা হয়।

ইহার কিছুদিন পরে বন্ধুবর মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ওরফে লাল মিঞা আমার কলিকাতার মেসে যাইয়া উপস্থিত, ফরিদপুর সাহিত্য-সভায় সভাপতিত্ব করিবার জন্য শরৎচন্দ্রকে নিমন্ত্রণ করিতে হইবে। আমি বন্ধুবরকে বলিলাম, “শরৎচন্দ্র আজ ল কলেজের আহ্বানে একটি সভায় বক্তৃতা করতে যাবেন। তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলেছিলাম। তাই সাহিত্য-সভার সভাপতিত্ব করার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।” বন্ধুবর বলিলেন, “তুমি আমার সঙ্গে থেকো। তোমাকে তো শরৎবাবু চেনেন না। সুতরাং নিজের নাম প্রকাশ না করে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললে এদিক দিয়ে কোনোই অসুবিধে হবে না।” সুতরাং বন্ধুবরকে সঙ্গে করিয়া ল কলেজের সভায় আসিলাম। সেখানে স্নেহপ্রবণ বিচিত্রা-সম্পাদক শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রনাথও আসিয়াছিলেন। তাঁহাকে ধরিলাম, আমাদের সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করিবার জন্য শরৎবাবুকে বলিয়া দিতে হইবে।

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

জেন জি এখন সুগন্ধি খুঁজছে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১২)

১১:৩০:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫

শরৎ-সন্নিধানে

শরৎচন্দ্রের সাহিত্য লইয়া আমাদের ফরিদপুর সাহিত্য-সভায় একদিন আলোচনা হইয়াছিল। তাহাতে আমি শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের বিষয়ে যে সকল কথা বলিয়াছিলাম, তাহার সঙ্গে অন্যান্য সভ্যের মোটেই মতের মিল ছিল না। যাঁহারা শরৎচন্দ্রকে বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি দাঁড় করান তাঁহাদের বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য এই ছিল যে, যুগ-প্রবর্তক সাহিত্যিকেরা আসেন প্রতিভার আলোকস্তম্ভ জ্বালাইয়া। দূর দূরান্তর হইতে কালের পথিকেরা সেই আলোকস্তম্ভদেখিতে পায়।

বঙ্কিমের সাহিত্যের প্রতি আমরা যখন লক্ষ করি তখন আমরা তাঁর ভাবে-ভাষায়-দৃষ্টিতে একেবারে এক সম্পূর্ণ অভিনব ব্যাপার দেখিতে পাই। ঈশ্বর গুপ্তের বা বিদ্যাসাগরের আমলে ইহা কেহই অনুমান করিতে পারিত না। তেমনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের আর এক নবীন জগতের সহিত আমরা পরিচিত হই। সকল সংস্কারের ঊর্ধ্বে দাঁড়াইয়া এরূপ ভাবে রস-বিতরণ বঙ্কিমের যুগে কেহই কল্পনা করিতে পারিত না। ভাবে, ভাষায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের জগৎ বঙ্কিমের জগৎ হইতে একেবারে পৃথক। সেইভাবে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম প্রভৃতি যুগ-প্রবর্তক সাহিত্য-স্রষ্টাদের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইঁহাদের একের জগৎ অপরের জগৎ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

শরৎচন্দ্রের সাহিত্য-প্রতিভাকে রবীন্দ্রনাথের সমপর্যায়ে ফেলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষার উপর দাঁড়াইয়াই শরৎচন্দ্র তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছেন। একমাত্র সামাজিক সমস্যা ছাড়া শরৎ-সাহিত্যে আর কোনো নূতন সমস্যা আলোচিত হয় নাই।

আমার এই কথার মধ্যে কতকটা যে বাড়াবাড়ি আছে, সে কথা আজ বুঝিতে পারিতেছি। শরৎচন্দ্র শরৎচন্দ্রই এবং রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই। গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য পদ্ম ফুলে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তাই বলিয়া পদ্ম ফুলের মূল্য কমিয়া যায় না। তাহা ছাড়া সাহিত্যের অভিনবত্ব দেখিয়াই সাহিত্য বিচার চলে না। তাহা যদি চলিত তবে ঈশ্বর গুপ্তও যুগ-প্রবর্তক সাহিত্যস্রষ্টা হইয়া রবীন্দ্রনাথের সমান আদর পাইতেন।

কিন্তু সেদিনকার সাহিত্য-সভায় আমার আলোচনা লইয়া এক তুমুল প্রতিবাদ চলে। সভায় সকলের মত ছিল, শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের চাইতে প্রতিভায় কোনো অংশে হীন তো নহেনই, বরঞ্চ কোনো কোনো বিষয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন। যেমন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের ঘরের কথা, সুখদুঃখের কথা। এই সভার খবর এসোসিয়েটেড প্রেসের মারফত কয়েকটি দৈনিক কাগজে ছাপা হয়।

ইহার কিছুদিন পরে বন্ধুবর মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ওরফে লাল মিঞা আমার কলিকাতার মেসে যাইয়া উপস্থিত, ফরিদপুর সাহিত্য-সভায় সভাপতিত্ব করিবার জন্য শরৎচন্দ্রকে নিমন্ত্রণ করিতে হইবে। আমি বন্ধুবরকে বলিলাম, “শরৎচন্দ্র আজ ল কলেজের আহ্বানে একটি সভায় বক্তৃতা করতে যাবেন। তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলেছিলাম। তাই সাহিত্য-সভার সভাপতিত্ব করার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।” বন্ধুবর বলিলেন, “তুমি আমার সঙ্গে থেকো। তোমাকে তো শরৎবাবু চেনেন না। সুতরাং নিজের নাম প্রকাশ না করে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললে এদিক দিয়ে কোনোই অসুবিধে হবে না।” সুতরাং বন্ধুবরকে সঙ্গে করিয়া ল কলেজের সভায় আসিলাম। সেখানে স্নেহপ্রবণ বিচিত্রা-সম্পাদক শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রনাথও আসিয়াছিলেন। তাঁহাকে ধরিলাম, আমাদের সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করিবার জন্য শরৎবাবুকে বলিয়া দিতে হইবে।

চলবে…..