০২:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১৪)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
  • 94

শরৎ-সন্নিধানে

আমি এ কথার প্রতিবাদ করিলাম, “মুসলমান সমাজের প্রতি সে যুগের হিন্দু সাহিত্যিকেরা কম আক্রমণ করেন নি। তাঁরা অনেকেই মুসলমানদের ভালোবাসতেন না। তা সত্ত্বেও দেশের মুসলমানেরা বিশেষ কোনো চাঞ্চল্য প্রকাশ করেনি। আপনি ভালোবেসে যদি তাদের বিরুদ্ধেও কিছু বলেন, তারা তা অন্যভাবে গ্রহণ করবে না। ভালোবাসার আবেদন কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না।” এই কথাটির উপরে আমি খুবই জোর দিলাম। শরৎচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “জসীম। তুমি কবি। তোমরা ‘আইডিয়ালিজম’ বা আদর্শ নিয়ে থাক। বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় তোমাদের কম। তাই ওরূপ বলছ। হিন্দু-সমাজের কথা আমি লিখেছি সত্য। কিন্তু আমি সেই সমাজকে যতটা গাল দিয়েছি, প্রশংসা তার শতাংশের একাংশও করিনি।”

দেখিলাম কথায় কথায় শরৎচন্দ্র আমাকে চিনিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু আলাপে আলোচনায় সেই অল্প সময়েই তাঁর সহিত এত অন্তরঙ্গ হইয়া পড়িলাম যে কিছুদিন আগে যে তাঁহার সাহিত্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা করিয়াছিলাম সেজন্য মনে এতটুকুও সঙ্কোচ আসিল না। শরৎচন্দ্র বলিলেন, “তুমি আমার ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্ব পড়েছ?” আমি উত্তর করিলাম, “আপনার ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্ব এই সবে বের হয়েছে। এখনও পড়িনি।”

শরৎবাবু বলিলেন, ” ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্বে গহর নামে একটি চরিত্রের অবতারণা করেছি। গহর আমার বাল্যবন্ধু ছিল। সে যে কত রাশি রাশি কবিতাই না লিখত। গহরের মা আমাকে বড্ড ভালোবাসতেন। কত সময় পিঠে তৈরি করে খাওয়াতেন। গহরের বাপ ছিল ভয়ঙ্কর কঞ্জুস। গ্রামে টাকা-পয়সার লগ্নি কারবার করত। মাঝে মাঝে সে গহরের মাকে ধরে ঠেঙাত। গহরের সহিত গ্রামের বনে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম। কোনোদিনও মনে হয় নাই গহর মুসলমান আর আমি হিন্দু। তাকেই অবলম্বন করে, ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্বে একটি ছোট্ট চরিত্রের অবতারণা করেছি। পড়ে দেখো, কেমন লাগে।”

এইভাবে নানা প্রকারের কথাবার্তায় আমরা হাওড়া হইতে ঘুরিয়া শিশিরবাবুর থিয়েটারে আসিলাম। সেখানে শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’ নাটক অভিনীত হইতেছিল। শরৎচন্দ্র ভিতরে যাইয়া শিশিরবাবুর ঘরে বসিলেন। শিশিরবাবুকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন, “দত্তা’র নাটকীয় সংস্করণ সবটা লিখে ফেলেছি। আজ সারা রাত জেগেছি। হরিদাস পড়ে তো খুব ভালোই বলল। শেষের দিকটা একেবারে নূতন করে লিখতে হয়েছে।” শিশিরবাবু বলিলেন, “আপনার এই বইখানা নিয়েই আবার আমি উঠব।” তাঁহারা কথাবার্তা বলতে লাগিলেন, আমরা চলিয়া আসিলাম।

ইহার পরে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্ব পড়িয়া একেবারে পাগল হইয়া উঠিলাম। বই যখন প্রায় অর্ধেক শেষ হইয়াছে তখন এই আনন্দরস তাড়াতাড়ি ফুরাইয়া যাইবে মনে করিয়া প্রতিদিন ২ পাতার বেশি পড়িতাম না। চতুর্থ পর্বের গহর ও কমললতা শরৎ-সাহিত্যের এক অভিনব সৃষ্টি। বই পড়া শেষ হইলে একদিন শরৎচন্দ্রের বাসায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম।

প্রথমেই তাঁহার ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিলাম। শরৎচন্দ্র হাসিলেন। আমি বলিলাম, “এই বই-এ আপনি রাজলক্ষ্মীকে যেন ইচ্ছা করেই বড় রাখতে চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু কমললতা আপন মহিমায় আপনি ফুটে উঠে আপনার এত আদরের রাজলক্ষ্মীর প্রভাব যেন স্নান করে দিয়েছে। আপন সৃষ্টির কাছে এ যেন শিল্পীর পরাজয়।” শরৎচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “আমিই তো কমললতাকে অমন করে সৃষ্টি করেছি।” আজ বুঝিতেছি আমার উপরিউক্ত মন্তব্যে কত গলদ ছিল।

ইহার পরে আরও দুই তিন বার শরৎচন্দ্রের সহিত দেখা হইয়াছে। রসচক্রের অধিবেশনে একদিন তিনি সুকবি কালিদাস রায়ের সহিত ব্যাকরণশাস্ত্র লইয়া আলোচনা করিতেছিলেন। অলঙ্কার ও ব্যাকরণশাস্ত্রের কালিদাস রায়ের গভীর জ্ঞান আছে একথা সকলেই জানেন। কিন্তু সেদিন দেখিলাম এ বিষয়ে শরৎচন্দ্রের জ্ঞান তাঁহার চাইতে অনেক বেশি। নির্ভুল বাংলা লিখতে শরৎচন্দ্র মুগ্ধবোধ, কলাপ প্রভৃতি ব্যাকরণশাস্ত্র অতি গভীরভাবে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। শরৎ-সাহিত্য বাহির হইতে পড়িয়া যাঁহারা রস উপভোগ করেন তাঁহারা জানেন না এই সাহিত্যের অন্তরালে শরৎচন্দ্রের কি গভীর সাধনা রহিয়াছে।

আজ শরৎচন্দ্রের মৃত্যুতে বাংলা দেশের অশেষ ক্ষতি হইল। বাংলা মধ্যবিত্ত হিন্দু-সমাজের কথা এমন করিয়া আর কেহ বলিতে পারিবেন কিনা সন্দেহ। শরৎচন্দ্রের বইগুলির ভিতর দিয়া আমরা হিন্দু-সমাজকে অতি শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিবার শিক্ষা পাইয়াছি। রবীন্দ্রনাথ বাংলা দেশের সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িকতার হাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ নিছক রস-পিপাসুদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তাই তাঁহার সাহিত্যে কোথাও সাম্প্রদায়িকতা নাই। শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের উপযুক্ত শিষ্য। তাঁহার আজীবন সাহিত্য-সাধনায় কোথাও সাহিত্যের সেই অসাম্প্রদায়িক বুনিয়াদ হইতে তিনি বিচ্যুত হন নাই।

চলবে…..

 

জনপ্রিয় সংবাদ

জেন জি এখন সুগন্ধি খুঁজছে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১৪)

১১:০০:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

শরৎ-সন্নিধানে

আমি এ কথার প্রতিবাদ করিলাম, “মুসলমান সমাজের প্রতি সে যুগের হিন্দু সাহিত্যিকেরা কম আক্রমণ করেন নি। তাঁরা অনেকেই মুসলমানদের ভালোবাসতেন না। তা সত্ত্বেও দেশের মুসলমানেরা বিশেষ কোনো চাঞ্চল্য প্রকাশ করেনি। আপনি ভালোবেসে যদি তাদের বিরুদ্ধেও কিছু বলেন, তারা তা অন্যভাবে গ্রহণ করবে না। ভালোবাসার আবেদন কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না।” এই কথাটির উপরে আমি খুবই জোর দিলাম। শরৎচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “জসীম। তুমি কবি। তোমরা ‘আইডিয়ালিজম’ বা আদর্শ নিয়ে থাক। বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় তোমাদের কম। তাই ওরূপ বলছ। হিন্দু-সমাজের কথা আমি লিখেছি সত্য। কিন্তু আমি সেই সমাজকে যতটা গাল দিয়েছি, প্রশংসা তার শতাংশের একাংশও করিনি।”

দেখিলাম কথায় কথায় শরৎচন্দ্র আমাকে চিনিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু আলাপে আলোচনায় সেই অল্প সময়েই তাঁর সহিত এত অন্তরঙ্গ হইয়া পড়িলাম যে কিছুদিন আগে যে তাঁহার সাহিত্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা করিয়াছিলাম সেজন্য মনে এতটুকুও সঙ্কোচ আসিল না। শরৎচন্দ্র বলিলেন, “তুমি আমার ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্ব পড়েছ?” আমি উত্তর করিলাম, “আপনার ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্ব এই সবে বের হয়েছে। এখনও পড়িনি।”

শরৎবাবু বলিলেন, ” ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্বে গহর নামে একটি চরিত্রের অবতারণা করেছি। গহর আমার বাল্যবন্ধু ছিল। সে যে কত রাশি রাশি কবিতাই না লিখত। গহরের মা আমাকে বড্ড ভালোবাসতেন। কত সময় পিঠে তৈরি করে খাওয়াতেন। গহরের বাপ ছিল ভয়ঙ্কর কঞ্জুস। গ্রামে টাকা-পয়সার লগ্নি কারবার করত। মাঝে মাঝে সে গহরের মাকে ধরে ঠেঙাত। গহরের সহিত গ্রামের বনে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম। কোনোদিনও মনে হয় নাই গহর মুসলমান আর আমি হিন্দু। তাকেই অবলম্বন করে, ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্বে একটি ছোট্ট চরিত্রের অবতারণা করেছি। পড়ে দেখো, কেমন লাগে।”

এইভাবে নানা প্রকারের কথাবার্তায় আমরা হাওড়া হইতে ঘুরিয়া শিশিরবাবুর থিয়েটারে আসিলাম। সেখানে শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’ নাটক অভিনীত হইতেছিল। শরৎচন্দ্র ভিতরে যাইয়া শিশিরবাবুর ঘরে বসিলেন। শিশিরবাবুকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন, “দত্তা’র নাটকীয় সংস্করণ সবটা লিখে ফেলেছি। আজ সারা রাত জেগেছি। হরিদাস পড়ে তো খুব ভালোই বলল। শেষের দিকটা একেবারে নূতন করে লিখতে হয়েছে।” শিশিরবাবু বলিলেন, “আপনার এই বইখানা নিয়েই আবার আমি উঠব।” তাঁহারা কথাবার্তা বলতে লাগিলেন, আমরা চলিয়া আসিলাম।

ইহার পরে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্ব পড়িয়া একেবারে পাগল হইয়া উঠিলাম। বই যখন প্রায় অর্ধেক শেষ হইয়াছে তখন এই আনন্দরস তাড়াতাড়ি ফুরাইয়া যাইবে মনে করিয়া প্রতিদিন ২ পাতার বেশি পড়িতাম না। চতুর্থ পর্বের গহর ও কমললতা শরৎ-সাহিত্যের এক অভিনব সৃষ্টি। বই পড়া শেষ হইলে একদিন শরৎচন্দ্রের বাসায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম।

প্রথমেই তাঁহার ‘শ্রীকান্ত’ চতুর্থ পর্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিলাম। শরৎচন্দ্র হাসিলেন। আমি বলিলাম, “এই বই-এ আপনি রাজলক্ষ্মীকে যেন ইচ্ছা করেই বড় রাখতে চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু কমললতা আপন মহিমায় আপনি ফুটে উঠে আপনার এত আদরের রাজলক্ষ্মীর প্রভাব যেন স্নান করে দিয়েছে। আপন সৃষ্টির কাছে এ যেন শিল্পীর পরাজয়।” শরৎচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “আমিই তো কমললতাকে অমন করে সৃষ্টি করেছি।” আজ বুঝিতেছি আমার উপরিউক্ত মন্তব্যে কত গলদ ছিল।

ইহার পরে আরও দুই তিন বার শরৎচন্দ্রের সহিত দেখা হইয়াছে। রসচক্রের অধিবেশনে একদিন তিনি সুকবি কালিদাস রায়ের সহিত ব্যাকরণশাস্ত্র লইয়া আলোচনা করিতেছিলেন। অলঙ্কার ও ব্যাকরণশাস্ত্রের কালিদাস রায়ের গভীর জ্ঞান আছে একথা সকলেই জানেন। কিন্তু সেদিন দেখিলাম এ বিষয়ে শরৎচন্দ্রের জ্ঞান তাঁহার চাইতে অনেক বেশি। নির্ভুল বাংলা লিখতে শরৎচন্দ্র মুগ্ধবোধ, কলাপ প্রভৃতি ব্যাকরণশাস্ত্র অতি গভীরভাবে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। শরৎ-সাহিত্য বাহির হইতে পড়িয়া যাঁহারা রস উপভোগ করেন তাঁহারা জানেন না এই সাহিত্যের অন্তরালে শরৎচন্দ্রের কি গভীর সাধনা রহিয়াছে।

আজ শরৎচন্দ্রের মৃত্যুতে বাংলা দেশের অশেষ ক্ষতি হইল। বাংলা মধ্যবিত্ত হিন্দু-সমাজের কথা এমন করিয়া আর কেহ বলিতে পারিবেন কিনা সন্দেহ। শরৎচন্দ্রের বইগুলির ভিতর দিয়া আমরা হিন্দু-সমাজকে অতি শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিবার শিক্ষা পাইয়াছি। রবীন্দ্রনাথ বাংলা দেশের সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িকতার হাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ নিছক রস-পিপাসুদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তাই তাঁহার সাহিত্যে কোথাও সাম্প্রদায়িকতা নাই। শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের উপযুক্ত শিষ্য। তাঁহার আজীবন সাহিত্য-সাধনায় কোথাও সাহিত্যের সেই অসাম্প্রদায়িক বুনিয়াদ হইতে তিনি বিচ্যুত হন নাই।

চলবে…..