১২:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
আলোকে শিল্পে রূপ দেওয়া লিন্ডসি অ্যাডেলম্যান পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ ‘ইনল্যান্ড টাইপ্যান’: প্রাণঘাতী বিষ, শান্ত স্বভাবের এই সরীসৃপের অজানা বিস্ময় কুমিল্লায় দায়িত্ব পালনকালে অসুস্থ হয়ে পুলিশের মৃত্যু রবিবার থেকে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা ভিয়েতনামী ঔপন্যাসিক ড. ফান কুয়ে মাই শারজাহ বইমেলায় পাঠকদের মুগ্ধ করলেন মংলায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ প্রবাসী নারী পর্যটক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আরও ৮৩৪ জন পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষের বছর? প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রত্যাশীদের আমরণ অনশন ৬৫ ঘণ্টা অতিক্রম, সরকারের নীরবতা অব্যাহত গণভোটের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই: বিএনপি নেতা আমীর খসরু

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২২০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫
  • 90

দীনেশচন্দ্র

তাঁহাকে প্রায় সব সময়েই কোনো কিছু লিখিতে দেখা যাইত। লোকজনের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলিতেন, আবার সেই সঙ্গে তিনি বই পুস্তকও লিখিতেন। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ইংরেজি অনুবাদ, ‘বৃহৎবঙ্গের’ পান্ডুলিপিগুলি তিনি এইভাবে প্রস্তুত করিয়াছিলেন।

বই-পুস্তকের মধ্যে তাঁহার সেই গভীর ধ্যানস্থ মূর্তি আজও যেন ছবির মতো আমার চক্ষুর সম্মুখে ভাসিতেছে। জ্ঞানপথের এত বড় একনিষ্ঠ সাধক আর কোথাও দেখি নাই। তাঁহার বিরাট ‘বৃহৎবঙ্গ’ পুস্তকখানা প্রায় দীর্ঘ তিন বৎসরে তিনি সম্পূর্ণ করিয়াছেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁহার দৌহিত্রদের ভীষণ মরণাপন্ন অসুখ হইয়াছে। একজনের মৃত্যুও হইয়াছে। তাঁহার স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছেন। এই সমস্ত দুঃসময়েও দেখিয়াছি তিনি পূর্বের মতোই সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাগ্রমনে বসিয়া ‘বৃহৎবঙ্গের’ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। এই ছবি জীবনে কোনো দিনই ভুলিতে পারিব না।

‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহ করিতে যাইয়া আমার মনে সন্দেহের উদয় হইল, এগুলি গ্রামে যেভাবে গাওয়া হয় যথাযথ সেই ভাবেই সংগ্রহ করা হয় নাই। গীতিকা-সংগ্রাহক

উহার উপর কিছু রং চড়াইয়াছেন। এই কথা আমি দুই এক জন বন্ধু-বান্ধবের নিকট আলোচনা করি। তাহা দীনেশবাবুর কানে যায়। দীনেশবাবু আমাকে এ বিষয়ে জবাবদিহি করিতে পত্র লিখিলেন।

আমি তখন সবেমাত্র ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহের ভার পাইয়াছি। দীনেশবাবুর পত্র পাইয়া আমার মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। সত্য কথা বলিলে দীনেশবাবু নিশ্চয় আমাকে এ কার্যে আর রাখিবেন না। আমি চারিদিন নির্জনে বসিয়া চিন্তা করিলাম। তখনকার ছেলেমানুষির কথা ভাবিলে এখন হাসি পায়। গ্রাম্য ফকিরদের বৈঠকে বসিয়া কত প্রার্থনা করিলাম। তারপর দীনেশবাবুকে আগাগোড়া সব কথা খুলিয়া লিখিলাম। দীনেশবাবু আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করিলেন না। তিনি শুধু লিখিলেন, “এ বিষয়ে তোমার ধারণা ভুল। পরে বুঝিতে পারিবে।”

মাঝে মাঝে আমি বন্ধু-বান্ধবদের বলিয়াছি, “দীনেশবাবুর মৃত্যুর পর ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহের গলদগুলি নিয়ে আলোচনা করব। তিনি আমার জীবনে সবচাইতে উপকারী বন্ধু, তিনি দুঃখ পান এমন কোনো কাজ তিনি জীবিত থাকতে আমি করব না।” এই খবর লোকমুখে শুনিয়া কবি কালিদাস রায়কে তিনি বলিয়াছিলেন, “জসীম মনে করেছে আমার মৃত্যুর পর সে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র বিরুদ্ধে সমালোচনা করবে। আমি মরলে এই বাঙলা দেশেই আবার ফিরে আসব। এই দেশের চাইতে সুন্দরতর স্বর্গ কোনো দিনই আমি কামনা করিনি। দেহের দিক দিয়ে হয়তো আমার মৃত্যু হবে, কিন্তু মনের দিক দিয়ে এই বাংলা দেশ ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।”

আজ দীনেশবাবু আমাদের মধ্যে আর নাই। তাঁহার আত্মা হয়তো বাঙলা দেশ ছাড়িয়া আর কোনো স্বর্গলোকেই বিরাজ করিতেছেন। তাঁহার মৃত্যুতে বাঙলা দেশের যে ক্ষতি হইল, বাংলাসাহিত্য গগনে একদা নূতন নক্ষত্রের উদয় হইয়া সেই ক্ষতির হয়তো কতকটা পূরণ হইবে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমি যাহা হারাইলাম তাহা আর কোনো দিনই পাইব না।

 

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

আলোকে শিল্পে রূপ দেওয়া লিন্ডসি অ্যাডেলম্যান

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২২০)

১১:০০:০৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

দীনেশচন্দ্র

তাঁহাকে প্রায় সব সময়েই কোনো কিছু লিখিতে দেখা যাইত। লোকজনের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলিতেন, আবার সেই সঙ্গে তিনি বই পুস্তকও লিখিতেন। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ইংরেজি অনুবাদ, ‘বৃহৎবঙ্গের’ পান্ডুলিপিগুলি তিনি এইভাবে প্রস্তুত করিয়াছিলেন।

বই-পুস্তকের মধ্যে তাঁহার সেই গভীর ধ্যানস্থ মূর্তি আজও যেন ছবির মতো আমার চক্ষুর সম্মুখে ভাসিতেছে। জ্ঞানপথের এত বড় একনিষ্ঠ সাধক আর কোথাও দেখি নাই। তাঁহার বিরাট ‘বৃহৎবঙ্গ’ পুস্তকখানা প্রায় দীর্ঘ তিন বৎসরে তিনি সম্পূর্ণ করিয়াছেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁহার দৌহিত্রদের ভীষণ মরণাপন্ন অসুখ হইয়াছে। একজনের মৃত্যুও হইয়াছে। তাঁহার স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছেন। এই সমস্ত দুঃসময়েও দেখিয়াছি তিনি পূর্বের মতোই সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাগ্রমনে বসিয়া ‘বৃহৎবঙ্গের’ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। এই ছবি জীবনে কোনো দিনই ভুলিতে পারিব না।

‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহ করিতে যাইয়া আমার মনে সন্দেহের উদয় হইল, এগুলি গ্রামে যেভাবে গাওয়া হয় যথাযথ সেই ভাবেই সংগ্রহ করা হয় নাই। গীতিকা-সংগ্রাহক

উহার উপর কিছু রং চড়াইয়াছেন। এই কথা আমি দুই এক জন বন্ধু-বান্ধবের নিকট আলোচনা করি। তাহা দীনেশবাবুর কানে যায়। দীনেশবাবু আমাকে এ বিষয়ে জবাবদিহি করিতে পত্র লিখিলেন।

আমি তখন সবেমাত্র ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহের ভার পাইয়াছি। দীনেশবাবুর পত্র পাইয়া আমার মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। সত্য কথা বলিলে দীনেশবাবু নিশ্চয় আমাকে এ কার্যে আর রাখিবেন না। আমি চারিদিন নির্জনে বসিয়া চিন্তা করিলাম। তখনকার ছেলেমানুষির কথা ভাবিলে এখন হাসি পায়। গ্রাম্য ফকিরদের বৈঠকে বসিয়া কত প্রার্থনা করিলাম। তারপর দীনেশবাবুকে আগাগোড়া সব কথা খুলিয়া লিখিলাম। দীনেশবাবু আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করিলেন না। তিনি শুধু লিখিলেন, “এ বিষয়ে তোমার ধারণা ভুল। পরে বুঝিতে পারিবে।”

মাঝে মাঝে আমি বন্ধু-বান্ধবদের বলিয়াছি, “দীনেশবাবুর মৃত্যুর পর ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহের গলদগুলি নিয়ে আলোচনা করব। তিনি আমার জীবনে সবচাইতে উপকারী বন্ধু, তিনি দুঃখ পান এমন কোনো কাজ তিনি জীবিত থাকতে আমি করব না।” এই খবর লোকমুখে শুনিয়া কবি কালিদাস রায়কে তিনি বলিয়াছিলেন, “জসীম মনে করেছে আমার মৃত্যুর পর সে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র বিরুদ্ধে সমালোচনা করবে। আমি মরলে এই বাঙলা দেশেই আবার ফিরে আসব। এই দেশের চাইতে সুন্দরতর স্বর্গ কোনো দিনই আমি কামনা করিনি। দেহের দিক দিয়ে হয়তো আমার মৃত্যু হবে, কিন্তু মনের দিক দিয়ে এই বাংলা দেশ ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।”

আজ দীনেশবাবু আমাদের মধ্যে আর নাই। তাঁহার আত্মা হয়তো বাঙলা দেশ ছাড়িয়া আর কোনো স্বর্গলোকেই বিরাজ করিতেছেন। তাঁহার মৃত্যুতে বাঙলা দেশের যে ক্ষতি হইল, বাংলাসাহিত্য গগনে একদা নূতন নক্ষত্রের উদয় হইয়া সেই ক্ষতির হয়তো কতকটা পূরণ হইবে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমি যাহা হারাইলাম তাহা আর কোনো দিনই পাইব না।

 

চলবে…..