বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আন্দোলনটি কোটা সংস্কার থেকে শুরু হলেও দ্রুত তা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও কর্তৃত্ববাদ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিভিন্ন বয়স, পেশা ও সামাজিক অবস্থানের নারীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ। তারা শুধু প্রতিবাদে অংশ নেয়নি, নেতৃত্বও দিয়েছে। কিন্তু আন্দোলন শেষ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে—এই নারীরা ধীরে ধীরে জনসমক্ষে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন।
এই বিষয়টি সামনে আনেন ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদ্যুপুই (H.E. Marie Masdupuy)। তিনি সরাসরি প্রশ্ন তোলেন: “যে নারীরা জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তারা কোথায় গেলেন? কেন তারা অদৃশ্য হয়ে গেলেন?” একই প্রশ্ন ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সামাজিক কল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ। এখন সেই প্রশ্নের বিশ্লেষণাত্মক উত্তর খোঁজার সময় এসেছে।
আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ
জুলাই আন্দোলনের সময় নারীরা ছিলেন সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায়।
- শিক্ষার্থী নারী:বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া তরুণীরা মাঠে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
- পেশাজীবী নারী:শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, সাংবাদিক—সবাই সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
- গ্রামীণ নারী ও প্রবীণ নারী:অনেক জায়গায় দেখা গেছে গৃহিণী ও মধ্যবয়সী নারীরাও রাস্তায় নেমেছেন।
এই আন্দোলনের ফলে নারীরা বাংলাদেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন।

আন্দোলনের সাফল্য এবং হঠাৎ অদৃশ্যতা
আন্দোলনের সাফল্যের পরপরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
- নারীদের মধ্যে যাদের নেতৃত্ব সবচেয়ে দৃশ্যমান ছিল,তারা হঠাৎ আর প্রকাশ্যে আসছেন না।
- জনসভা,মিছিল বা সংবাদমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি খুব সীমিত হয়ে গেছে।
- সাধারণ কর্মজীবী বা ছাত্রী নারীরাও,যারা রাস্তায় শ্লোগান দিয়েছিলেন, তারাও আর দেখা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদ্যুপুইয়ের প্রশ্নের মূল প্রেক্ষাপট এখানেই—কেন এই হঠাৎ অদৃশ্যতা?
সামাজিক কল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদের মন্তব্য
শারমিন মুরশিদ আন্দোলনের পর নারীদের অনুপস্থিতি নিয়ে পরিষ্কার করে বলেন:
- অনেক নারীমানসিক আঘাত ও ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
- অনেকেই আহত হয়েছিলেন,তারা এখন গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন।
- সামাজিক ও সাইবার আক্রমণ (সাইবার বুলিং) তাদেরকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
- “যে নারীরা রাস্তায় সাহসিকতা দেখিয়েছেন,তাদের নিয়ে আজ সমাজে নানা অপপ্রচার চলছে”—তিনি বলেন।
এমনকি তিনি স্বীকার করেন, অনেক নারী জনসম্মুখে আসতে ভয় পাচ্ছেন।

সরকার ও প্রশাসনের উদ্যোগ
এই সমস্যার সমাধানে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
- প্রায়১০০ জন নারীকে নিয়োগ করা হয়েছে—যারা আহত ও নিখোঁজ নারীদের খুঁজে বের করে সহায়তা করছেন।
- মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যকাউন্সেলিং প্রোগ্রাম শুরু করা হয়েছে।
- আহত নারীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
তবে অনেকেই এখনও নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি নন, নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে তারা অজ্ঞাত থাকতে চাইছেন।
নারীদের অদৃশ্যতার পেছনের কারণ: বিশ্লেষণ
১. সামাজিক ও মানসিক আঘাত
আন্দোলনের সময় নারীরা মার খেয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন, ভয়াবহ চাপ সহ্য করেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তাই আন্দোলনের পর তারা জনসমক্ষে সক্রিয়ভাবে ফিরে আসতে পারেননি।
২. সাইবার আক্রমণ ও সামাজিক কুৎসা
অনলাইনে আন্দোলনকারী নারীদের বিরুদ্ধে নানা গুজব ছড়ানো হয়েছে। “অশ্লীলতা”, “বিদেশি অর্থায়ন” ইত্যাদি অভিযোগে অনেক নারী মানসিক চাপে পড়ে গেছেন। এর ফলে তারা স্বেচ্ছায় জনজীবন থেকে দূরে সরে গেছেন।

৩. সাংগঠনিক প্রান্তিককরণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীদের নেতৃত্ব সীমিত করেছে। আন্দোলনের সময় তাদের ভূমিকা স্বীকৃতি পেলেও, পরবর্তীতে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক জায়গায় পুরুষ নেতৃত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে নারীরা প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন।
৪. রাজনৈতিক বিভাজন
আন্দোলন শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মতবিরোধ তৈরি হয়। এতে নারীরা আরও চাপে পড়েন। অনেক নারী দলাদলি ও দ্বন্দ্ব এড়িয়ে নীরব থাকতে বাধ্য হয়েছেন।
৫. নিরাপত্তাহীনতা
রাষ্ট্র ও সমাজ—দুই দিক থেকেই নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা ছিল প্রবল। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেক নারী গোপনে হুমকি পেয়েছেন। তাই তারা নিজেদের গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
৬. মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান
মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানের ফলে নারীরা নিজেরদের রাস্তায় নিরাপদও মনে করছে না।
রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদ্যুপুই এবং সামাজিক কল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদের বক্তব্য একটি গভীর সংকটকে সামনে আনে। জুলাই আন্দোলনে নারীরা যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মাইলফলক। কিন্তু আন্দোলনের পর তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত বা মানসিক সমস্যার কারণে নয়, বরং সামাজিক চাপ, রাজনৈতিক প্রান্তিককরণ এবং নিরাপত্তাহীনতার সমষ্টিগত ফলাফল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















