বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, বহুমাত্রিক এবং জটিল। একদিকে দুই দেশের ভৌগোলিক সান্নিধ্য, সাংস্কৃতিক বন্ধন, বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতা ও রাজনৈতিক ইতিহাস; অন্যদিকে সীমান্ত সমস্যা, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, পানি বণ্টন এবং রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব। এ কারণেই দেখা যায়, কখনো বাংলাদেশে ভারতকে বয়কট করার ডাক ওঠে, আবার কখনো ভারতের সঙ্গে আমদানি-বাণিজ্য বাড়লে সাধারণ মানুষও খুশি হয়। এই দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের অভ্যন্তরীণ সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভারত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে অনেকেই ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক সম্পর্কের উত্থান-পতনের কারণে ভারতের প্রতি ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে পানি ভাগাভাগি (তিস্তা, গঙ্গা), সীমান্তহত্যা কিংবা বাণিজ্য বৈষম্যের মতো ইস্যুগুলোতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জন্মেছে। এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশি সমাজে ভারতবিরোধী আবেগ মাঝেমাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
বয়কটের আবেগ
বাংলাদেশে অনেক সময় ভারতের বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলনের ডাক ওঠে। যেমন—ভারতীয় পণ্যের আমদানি বন্ধ করার দাবি বা বলিউড চলচ্চিত্র বয়কটের স্লোগান। এর পেছনে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারণা এবং সীমান্ত সমস্যা বা পানি বণ্টনের মতো অমীমাংসিত ইস্যুর প্রভাব থাকে। এ সময় জনগণ মনে করে, ভারত বাংলাদেশকে ‘প্রতিবেশী বন্ধুর’ পরিবর্তে ‘প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক ক্ষোভের ধারাবাহিকতায় এই আবেগ সামাজিক আন্দোলন বা রাজনৈতিক স্লোগানে রূপ নেয়।
আমদানি নির্ভরতা ও বাস্তবতা
অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত। অনেক ভোগ্যপণ্য—ডাল, পেঁয়াজ, চাল, মসলা, তুলা, এমনকি ওষুধ পর্যন্ত ভারতের বাজার থেকে আসে। যখন এসব পণ্যের আমদানি সহজ হয় বা দাম কমে, তখন সাধারণ মানুষ খুশি হয়। আবার ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও চুক্তি থাকায় সেখান থেকেও বাংলাদেশের লাভ হয়। তাই একদিকে আবেগ বয়কটের পক্ষে যায়, অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনের সুবিধা মানুষকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার পক্ষে টেনে আনে।

সমসাময়িক উদাহরণ
এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দৈনন্দিন বাজার পরিস্থিতিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের বাজারে দাম হু-হু করে বেড়ে যায়। তখন সাধারণ মানুষ ভারতবিরোধী স্লোগান তোলে এবং বয়কটের কথা বলে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই আবার ভারত যখন সীমিত পরিমাণে পেঁয়াজ রপ্তানি শুরু করে এবং বাজারে দামের চাপ কমে, তখন অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করে। একইভাবে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তির কারণে লোডশেডিং কিছুটা কমে এলে মানুষ খুশি হয়, কিন্তু চুক্তির রাজনৈতিক শর্ত নিয়ে সমালোচনাও হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা সবসময় আলোচিত। সরকারপক্ষ ভারতের সহযোগিতাকে উন্নয়ন ও কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু বিরোধীদল অনেক সময় ভারতকে ওই সব সরকারপন্থী হিসেবে অভিযুক্ত করে। এ কারণে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী ভারতবিরোধী বা ভারত-সমর্থক মনোভাব পোষণ করে। ২০০০ সালের পর থেকে এই প্রভাব বিশেষভাবে প্রকট হয়—কখনো তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ, আবার কখনো অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতীয় ঋণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব
ভারতের গান, সিনেমা, টিভি সিরিয়াল বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। আবার অনেক সময় এগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির ক্ষতি করছে বলে সমালোচনা ওঠে। তাই দেখা যায়, একদল মানুষ ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণে আনন্দিত হয়, অন্য দল সমালোচনা করে। যেমন—দুর্গাপূজা বা ক্রিকেট ম্যাচে দুই দেশের সম্পর্ক ইতিবাচক হয়ে ওঠে, আবার সীমান্তে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটলে ভারতবিরোধী আবেগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে ভারতের প্রতি মনোভাব দ্বৈত হওয়ার কারণ মূলত তিনটি—ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব। আবেগের জায়গায় ভারতকে বয়কট করার ডাক উঠলেও, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই একই জনগোষ্ঠী কখনো ভারতবিরোধী আবেগে রাস্তায় নামে, আবার কখনো ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে খুশিও হয়। এই দ্বৈত অবস্থাই বাংলাদেশের এক শ্রেণীর সাধারণ মানুষের বাস্তব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















