নতুন আর্থিক যুগের সূচনা
ডিজিটাল মুদ্রার এক নতুন যুগ শুরু হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো স্টেবলকয়েন বা স্থিতিশীল মুদ্রা। প্রযুক্তি যদি বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার পথ দেখাতে পারে, তবে এ খাতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড দ্বারা সমর্থিত প্রযুক্তিগত মুদ্রার উত্থান বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামোকে পাল্টে দিতে পারে।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর থেকে বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষের সম্পদ ক্ষয়, মুদ্রাস্ফীতি এবং আস্থার সংকট নতুন সমাধানের পথ খুঁজতে বাধ্য করেছে। এরই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থার প্রতি সন্দেহ বাড়ে, যেখানে ডলার প্রধান লেনদেন মুদ্রা ও রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ডলার নির্ভর অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা
ডলার এখন আর সোনার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র সীমাহীন ডলার ছাপালেও বিশ্বজুড়ে ডলারের চাহিদা এতটাই শক্তিশালী যে তা এই মুদ্রাস্ফীতিকে আড়াল করে দেয়। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘ট্রিফিন দোটানা’। ছোট অর্থনীতিগুলোকে ডলার-নির্ভরতার কারণে মুদ্রাস্ফীতির বোঝা বহন করতে হয় এবং তাদের জাতীয় সম্পদ ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
অন্যদিকে, ডলার-ভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফট যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কোনো দেশকে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করা কঠিনতম অর্থনৈতিক শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিটকয়েন থেকে ব্লকচেইন বিপ্লব
এই পরিস্থিতিতে ব্লকচেইন-ভিত্তিক প্রথম অ-সার্বভৌম ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের আবির্ভাব ঘটে। এরপর হাজারো ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি হয়, যা প্রথাগত আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে একটি বিকল্প শিল্প গড়ে তোলে।
বিটকয়েনের বৈশিষ্ট্য হলো: এটি সীমিত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, লেনদেন অপরিবর্তনীয় এবং সুইফটের বাইরে পরিচালিত। এই মডেলের কারণে তা রাজনৈতিক অর্থায়ন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অস্বচ্ছ লেনদেনের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে শুরু করে। যদিও ব্লকচেইন প্রযুক্তি দ্রুত, স্বচ্ছ এবং খরচ কমানোর সুযোগ এনে দেয়, তবুও বিটকয়েনের মতো মুদ্রা অতিমাত্রায় অস্থির এবং অপরাধমূলক কাজে ব্যবহারের ঝুঁকি বেশি।
ব্রিকস ও স্বর্ণ-ভিত্তিক লেনদেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবেলায় চীন ও ব্রিকস দেশগুলো ডিজিটাল লেনদেনে সোনা ব্যবহার করছে। সোনা ভল্টে থাকলেও মালিকানা হস্তান্তর হচ্ছে ব্লকচেইনের মাধ্যমে। এর ফলে তেল ও পণ্যের লেনদেন ডলার ছাড়া সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি চীন নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম সিআইপিএস চালু করেছে। তবে ইউয়ান অস্থির ও অবিশ্বস্ত হওয়ায় সোনাভিত্তিক লেনদেন বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও দ্রুত স্বর্ণ রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। মে ২০২৫-এ বিশ্ব স্বর্ণ পরিষদের এক জরিপে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণ রিজার্ভ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেবলকয়েন কৌশল
যুক্তরাষ্ট্র এখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ডলারের প্রতি আস্থা কমছে এবং ব্লকচেইন-ভিত্তিক বিকল্প ব্যবস্থা ডলারকে বাইপাস করছে। এই প্রেক্ষাপটে স্টেবলকয়েনকে সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০২৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট “স্টেবল অ্যাক্ট” পাশ করেছে, যার মাধ্যমে ডলার-সমর্থিত টোকেনভিত্তিক মুদ্রা চালুর আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বন্ড কিনে স্টেবলকয়েন ইস্যু করতে পারবে, যেখানে ১ স্টেবলকয়েন সমান ১ ডলার ধরা হবে।
এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে সরকারি বন্ডের চাহিদা সৃষ্টি করতে পারবে, যেখানে প্রযুক্তি কোম্পানি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্টেবলকয়েন ইস্যু করে আর্থিক সেবা দেবে এবং একইসঙ্গে সুদ আয় করবে।
ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
স্টেবলকয়েন যেমন নতুন সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি এর সঙ্গে নানা ঝুঁকিও জড়িত। বিষয়গুলো ক্রমানুসারে বোঝা প্রয়োজন।
মুদ্রার এককত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঝুঁকি
স্টেবলকয়েন ডলারের সঙ্গে ১:১ মানে বাঁধা হলেও এটি প্রকৃত অর্থে ডলার নয়। বাস্তবে এর মান ওঠানামা করতে পারে, ফলে মানুষ মুদ্রার স্থিতিশীলতার ওপর আস্থা হারাতে পারে।