শিয়াল বাংলাদেশের অন্যতম পরিচিত ও প্রাচীন বন্যপ্রাণী। এটি ক্যানিডে (Canidae) পরিবারের সদস্য, যেখানে কুকুর, নেকড়ে ও শৃগালও অন্তর্ভুক্ত। শিয়াল মূলত নিশাচর প্রাণী, তবে প্রয়োজনে দিনের বেলাতেও সক্রিয় হতে দেখা যায়। এর বুদ্ধিমত্তা, শিকারি দক্ষতা এবং অভিযোজন ক্ষমতা গ্রামীণ লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন ও গল্পে বহু যুগ ধরে স্থান পেয়েছে। দুই শতাব্দী আগে বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রান্তর, বনাঞ্চল, চরভূমি ও হাওর-বাঁওড়ে শিয়ালের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এদের দেখা মিলত।
২০০ বছরের ঐতিহাসিক ডেটাসেট ও তুলনা
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৮২৫ সালের দিকে শিয়ালের ঘনত্ব বাংলাদেশের প্রায় সব বিভাগে বেশি ছিল। গুণগতভাবে স্কোর করলে দেখা যায়—রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহে ঘনত্ব ছিল খুব বেশি, অর্থাৎ স্কোর ৪। সিলেট, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে ঘনত্ব কিছুটা কম হলেও তবুও ছিল উচ্চ, অর্থাৎ স্কোর ৩। বর্তমানে ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে এই চিত্র অনেক বদলে গেছে। রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহে ঘনত্ব মাঝারি থেকে বেশি পর্যায়ে নেমে এসেছে, স্কোর ৩। সিলেটে ঘনত্ব মাঝারি, স্কোর ২। ঢাকায় এটি নেমে গেছে খুব কমে, স্কোর ১। খুলনা ও বরিশালে ঘনত্ব মাঝারি, স্কোর ২। চট্টগ্রামেও বর্তমানে ঘনত্ব মাঝারি, স্কোর ২। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নগরায়ন, বন উজাড়, কৃষিজমি সম্প্রসারণ এবং মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত বৃদ্ধি।

জনসংখ্যা হ্রাসের সূচনা
শিয়ালের জনসংখ্যা হ্রাস শুরু হয় প্রায় দেড় শতাব্দী আগে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। তখন কৃষির জন্য ব্যাপকভাবে বন উজাড়, আবাদি জমি সম্প্রসারণ এবং গ্রামে স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠা শুরু হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতার পর শিল্পাঞ্চল বিস্তার, মহাসড়ক নির্মাণ, গ্রামীণ বনভূমি ধ্বংস এবং বসতবাড়ি বৃদ্ধির ফলে শিয়ালের বসবাসের এলাকা ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকে। বিশেষত ১৯৭০-এর দশকের পর জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং পোলট্রি বা হাঁস-মুরগি খামারের প্রসারের ফলে মানুষের সঙ্গে শিয়ালের দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়, যা স্থানীয়ভাবে শিকার ও নিধন বাড়িয়ে দেয়।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগে শিয়ালের সংখ্যা অতীতের তুলনায় কম। সরকারি বা আনুষ্ঠানিক কোনো পূর্ণাঙ্গ জনসংখ্যা জরিপ নেই, তবে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, সারা দেশে এখন কয়েক হাজারের বেশি শিয়াল নেই। আগে যেখানে গ্রামভিত্তিকভাবে শিয়ালের দেখা মিলত, এখন তা সীমিত কয়েকটি এলাকায় সীমাবদ্ধ।

অতীতে সমৃদ্ধ এলাকা
অতীতে শিয়ালের সমৃদ্ধ আবাস ছিল সুন্দরবনের প্রান্তবর্তী গ্রামাঞ্চল ও চরভূমি, রাজশাহী, নাটোর ও বগুড়ার খোলা মাঠ ও গাছপালার বেষ্টনী, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ চরভূমি, এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রান্তর।
বর্তমানে তুলনামূলক বেশি উপস্থিত এলাকা
বর্তমানে তুলনামূলক বেশি শিয়াল টিকে আছে সুন্দরবনের বাইরের প্রান্তবর্তী এলাকা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের কিছু চরাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল, এবং নওগাঁ ও নাটোরের কিছু গ্রামীণ বনাঞ্চলে।
আচরণ ও জীবনচক্র
শিয়াল একটি নিশাচর ও সর্বভুক প্রাণী। রাতে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ করে এবং দিনে গর্ত, ঝোপঝাড় বা ফসলের আড়ালে বিশ্রাম নেয়। এদের খাদ্যের মধ্যে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ, পোকামাকড়, ফলমূল, এমনকি মৃত প্রাণীর দেহও অন্তর্ভুক্ত। গর্ভধারণকাল সাধারণত ৫০-৬০ দিন এবং একবারে ৩-৬টি শাবক জন্ম দেয়। জন্মের পর প্রায় দুই সপ্তাহ শাবকের চোখ বন্ধ থাকে, এবং এই সময় মা তাদের দুধ খাওয়ায়। চার থেকে পাঁচ মাস বয়সে শাবকরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।

মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
মানুষের সঙ্গে শিয়ালের সম্পর্ক মিশ্র প্রকৃতির। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে শিয়াল যেমন বুদ্ধিমত্তার প্রতীক, তেমনি হাঁস-মুরগি বা পোষা প্রাণী শিকার করার কারণে কৃষকরা একে ক্ষতিকর হিসেবে দেখে। এই কারণে গ্রামীণ অনেক এলাকায় শিয়াল তাড়ানো বা হত্যা করা হয়েছে, যা সংখ্যা হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে।
সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তা
সংরক্ষণের দিক থেকে শিয়াল এখনও বিপন্ন তালিকায় নেই, তবে এর সংখ্যা কমছে। বাসস্থান ধ্বংস, খাদ্যের অভাব এবং শিকার—এই তিনটি প্রধান কারণ দূর না করা গেলে ভবিষ্যতে শিয়াল দেশের বহু অঞ্চল থেকে হারিয়ে যেতে পারে। এজন্য গ্রামীণ বনাঞ্চল সংরক্ষণ, অবৈধ শিকার নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্যশৃঙ্খলার ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















