০৪:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
‘সুইম শেডি’ নাম নিয়ে আইনি লড়াইয়ে এমিনেম দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের উপকূলীয় শহর ওওইতায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, পুড়ল শতাধিক ঘর বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুতে এগোচ্ছে জাপান গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছে না, এবার রবির বিরুদ্ধে অভিযোগ — জিপি ও বাংলালিংকের আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইশতেহারে শিশু নিরাপত্তা জোরদারের প্রতিশ্রুতি ভারতের স্পষ্ট বার্তা: যেখানেই হোক, সন্ত্রাস দমনে অভিযান চালানোর পূর্ণ অধিকার আছে ইভি আর স্মার্ট গ্যাজেটের জোরে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা দেখাল শাওমি ভারতের রেড ফোর্ট হামলার উদ্ধার হওয়া ভিডিও: আত্মঘাতী হামলার সাফাই দিচ্ছিলেন উমর উন-নবী ইন্দোনেশিয়ার শিশুদের ভিডিও গেমে জঙ্গি প্রভাব: পুলিশ গাজীপুরে কয়েল কারখানায় ভয়াবহ আগুনঃ আশে পাশের মানুষ সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন

আহেটুল্লা নাসুটা বা ভাইন স্নেক: বাংলাদেশে ‘নাসুটা’ ও বাংলায় লাউ ডগা সাপ

আহেটুল্লা নাসুটা (Ahaetulla nasuta) দক্ষিণ এশিয়ার অতি চেনা ভাইন স্নেক বা ‘লতা সাপ’-এর এক নাম, যার খ্যাতি তার অবিশ্বাস্য সরু, সবুজ শরীর আর ঝুলন্ত ডালের মতো ছদ্মবেশের জন্য। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বড় এক সংশোধন এসেছে: আজকের হিসাবে Ahaetulla nasuta মূলত শ্রীলঙ্কার স্থানিক প্রজাতি; ভারত-বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের যেসব সাপকে আগে “নাসুটা” বলা হতো, তার বেশিরভাগকেই আলাদা প্রজাতি হিসেবে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই “নাসুটা” নামটি ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হলেও, বর্তমান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে আমাদের দেশে যে ভাইন স্নেকগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো অন্য প্রজাতির অন্তর্গত।

আহেটুল্লা নাসুটার বর্তমান বিস্তৃতি

নতুন ট্যাক্সোনমিক পর্যালোচনার (২০২০) পর Ahaetulla nasuta কেবল শ্রীলঙ্কাতেই সীমাবদ্ধ বলে ধরা হয়। আগে যাকে ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে পাওয়া যেত বলা হতো, তা আর প্রযোজ্য নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন জুটাক্সায় প্রকাশিত গবেষণার ভিত্তিতে গৃহীত।

বাংলাদেশে ‘নাসুটা’ নামের ঐতিহাসিক ব্যবহার ও আজকের বাস্তবতা

বাংলাদেশে বহু বছর “পাতি লাউডগা” বা “পঙ্খিরাজ” নামে যেটিকে লোকমুখে “নাসুটা” বলা হতো, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে—এসব রেকর্ড মূলত Ahaetulla anomala (ভ্যারিয়েবল কালার্ড ভাইন স্নেক) ও Ahaetulla prasina (ওরিয়েন্টাল হুইপ স্নেক/এশিয়ান ভাইন স্নেক)-এর সঙ্গে মিলে। অর্থাৎ, নামটি চলতি ভাষায় থেকে গেলেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিকভাবে থাকা ভাইন স্নেকগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে “নাসুটা” নয়। A. anomala এবং A. prasina—দুটোরই বিতরণে বাংলাদেশ রয়েছে।

বাংলাদেশে কোন কোন এলাকায় মিলত/মেলে

বাংলাদেশের আর্দ্র অরণ্য, চিরসবুজ/অর্ধচিরসবুজ বনাঞ্চল, বাগান-উপবন ও জলাশয়ের ধারঘেঁষা গাছপালায় ভাইন স্নেক দেখা যায়। দেশের ভৌগোলিক রেকর্ড ও নিকটবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ধারাবাহিক আবাসভিত্তিক প্রমাণ বিবেচনায়—সিলেটের চা-বাগান ও আর্দ্র বনভূমি, চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলার বনাঞ্চল, উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের ঝোপঝাড়ময় এলাকা—এসব জোনে ইতিহাসগতভাবে এই সাপের উপস্থিতি নথিবদ্ধ হয়েছে বা হতে পারে। তাছাড়া বাদামি রঙের ঘন দাগযুক্ত ভাইন স্নেক (পূর্বে A. pulverulenta নামে উদ্ধৃত; বর্তমানে শ্রীলঙ্কা-নির্দিষ্ট বলেই ধরা হয়) নিয়ে উত্তর-পশ্চিমের নওগাঁ-রাজশাহী অঞ্চলে একবার ছবি-ভিত্তিক উল্লেখ আছে; তবে নতুন ট্যাক্সোনমি প্রেক্ষিতে এমন রেকর্ডের প্রজাতি-পরিচয় পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে।

সংখ্যা: আগে কেমন ছিল, এখন কেমন

লোকালয়ে কম চোখে পড়লেও, ঝোপাল-আর্দ্র বনাঞ্চলে আগে তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যেত—বিশেষ করে চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে। কারণ, এসব সাপ দিবাচর ও বৃক্ষবাসী; মানুষের চোখ এড়ানো তাদের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার কৌশল। সাম্প্রতিক দশকে বনভূমি সংকোচন, ঝোপঝাড় পরিষ্কার, কীটনাশক ব্যবহার, এবং পোষ্য প্রাণী (বিড়াল ইত্যাদি)-জনিত চাপ বাড়ায় সম্ভাব্য আবাসক্ষেত্র ক্ষুদ্রকায় হয়েছে। ফলে ক্ষেত্র-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণে উপস্থিতি কমে এসেছে বলে স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমীদের অভিজ্ঞতায় উঠে আসে। সরকারি জাতীয় তালিকায় এই একক প্রজাতি হিসেবে পৃথক জনসংখ্যা-শুমারির নির্ভরযোগ্য প্রকাশ্য তথ্য সীমিত; কিন্তু আঞ্চলিক আবাসভিত্তিক সংকোচনের দিকটি সুপ্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশে এখন কোন কোন প্রজাতি দেখা যায়

১) Ahaetulla anomala — ভ্যারিয়েবল কালার্ড ভাইন স্নেক; বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশেই নথিবদ্ধ।
২) Ahaetulla prasina — ওরিয়েন্টাল/এশিয়ান ভাইন স্নেক; বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত।

ট্যাক্সোনমি আপডেট: কেন ‘নাসুটা’ নামটি বদলে গেল

২০২০ সালে মালিক ও সহগবেষকদের বড় এক পর্যালোচনায় দেখা যায়—দীর্ঘদিন “A. nasuta কমপ্লেক্স” বলে যেটা ধরা হতো, সেটি আসলে কয়েকটি আড়ালে থাকা (cryptic) প্রজাতির সমষ্টি। ফলে শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা ‘নাসুটা’ নামে থেকে গেলেও, উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ডের অনেক ‘নাসুটা’ রেকর্ডকে অন্য নাম (যেমন A. oxyrhyncha, A. anomala, A. borealis, A. farnsworthi, A. malabarica, A. travancorica, A. sahyadrensis ইত্যাদি) দেওয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে “বাংলাদেশে নাসুটা” কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে আর প্রযোজ্য নয়।

রূপ-লক্ষণ ও আচরণ (ভাইন স্নেকগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য)

ভাইন স্নেকের শরীর লতাগুল্মের মতো সরু ও দীর্ঘ; লেজ লম্বা; মাথা ত্রিভুজাকৃতি ও সামনের দিকে তীক্ষ্ণ। চোখ বড় এবং কী-হোল আকৃতির অনুভূমিক পিউপিল—যা সরীসৃপে বিরল বৈশিষ্ট্য। রং সাধারণত উজ্জ্বল সবুজ, তবে হলুদ/ধূসর/বাদামি ভাবও দেখা যায়—বিশেষ করে A. anomala-তে রঙের তারতম্য উল্লেখযোগ্য। ডালে-ডালে স্থির হয়ে দুলতে দুলতে ছদ্মবেশ নেওয়া ও ধীরে শিকার ধরা এদের কৌশল।

খাদ্যাভ্যাস

প্রধানত টিকটিকি ও গিরগিটি—এদের প্রিয় শিকার। জলাশয়ের ধারেকাছে থাকলে ব্যাঙও খায়। ডালে ঝুলে থেকে ধীর গতিতে ঘনিয়ে এসে আকস্মিক কামড়ে শিকার ধরতে দক্ষ।

বিষধরতা ও মানুষের জন্য ঝুঁকি

আহেটুল্লা গণের সাপগুলো ‘রিয়ার-ফ্যাংড’ বা পশ্চ-দন্তবিশিষ্ট। ডুভেরনোয়ের গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিষ শিকারকে অসাড় করতে সাহায্য করলেও, মানুষের জন্য সাধারণত গুরুতর চিকিৎসাজনিত জটিলতা তৈরি করে না—স্থানীয় ব্যথা, ফোলা বা ঝিনঝিনে অনুভূতি তৈরি হতে পারে। সতর্কতা জরুরি হলেও আতঙ্কের কারণ নয়।

প্রজনন

বেশিরভাগ ভাইন স্নেক ওভোভিভিপ্যারাস—অর্থাৎ ডিম মায়ের দেহেই বিকশিত হয়ে শাবক হিসেবে বাইরে আসে। আর্দ্র ও উষ্ণ বনভূমি—এদের জন্য উপযোগী পরিবেশ।

সংরক্ষণ অবস্থা ও হুমকি

আবাসস্থল সংকোচন—বনভূমি নিধন, ঝোপঝাড় পরিষ্কার, কীটনাশক—এগুলো বড় হুমকি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নগর-প্রান্তের বাগান/উপবনে গাছ কাটাছাঁটা ও পোষ্য বিড়ালের শিকারচাপও বিবেচ্য। আঞ্চলিকভাবে সচেতনতা, বাস্তুগত করিডর রক্ষা, এবং বাগান-বনায়নে ঝোপঝাড় রক্ষা—এসব পদক্ষেপ ভাইন স্নেকের টিকে থাকায় সহায়ক হবে। প্রজাতিভেদে বৈশ্বিক আইইউসিএন মূল্যায়ন ভিন্ন; A. prasina সাধারণত বিস্তৃত ও সাধারণ, A. anomala-ও এখনো গুরুতর ঝুঁকিতে ধরা হয় না।

“কতগুলো প্রজাতি”—আহেটুল্লা গণে প্রজাতি সংখ্যা

আহেটুল্লা গণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক নতুন প্রজাতি বর্ণিত হয়েছে ও পুরোনো ধারণা সংশোধিত হয়েছে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের তালিকায় সংখ্যাটি আলাদা হতে দেখা যায়—কেউ ১৮টির মতো, কেউবা ২০-এর বেশি বলছে; ২০২৪–২৫ সালের সংকলনে ১৮–২১টির মধ্যে ওঠানামা করছে। কাজেই নিরাপদভাবে বলা যায়, বর্তমানে আহেটুল্লা গণে প্রায় ১৮–২১টি প্রজাতি স্বীকৃত বা প্রস্তাবিত রয়েছে, এবং শ্রীলঙ্কা ও ভারতের পশ্চিমঘাট—দুটি ‘হটস্পট’ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ

১) “Ahaetulla nasuta” এখন শ্রীলঙ্কার স্থানিক প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়; বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে থাকা ভাইন স্নেকগুলোকে আগে নাসুটা বলা হলেও, নতুন ট্যাক্সোনমি অনুযায়ী সেগুলো মূলত A. anomala ও A. prasina।
২) বাংলাদেশের সম্ভাব্য/নথিবদ্ধ অঞ্চল—সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি, এবং বাগান-উপবনসমৃদ্ধ আর্দ্র আবাসস্থল; উত্তর-পশ্চিমে একসময় ‘বাদামি’ ভাইন স্নেক ধরনের ছবি-ভিত্তিক উল্লেখ আছে, তবে প্রজাতি-পরিচয় এখন পুনর্মূল্যায়নসাপেক্ষ।
৩) জনসংখ্যা: লোকালয়ে বিরল; আবাসক্ষেত্র সংকোচন ও কীটনাশক ব্যবহারের চাপে প্রত্যক্ষ দেখা কমেছে বলে স্থানীয় ক্ষেত্র-অভিজ্ঞতায় ইঙ্গিত।
৪) প্রজাতি সংখ্যা: আহেটুল্লা গণে মোটামুটি ১৮–২১টি প্রজাতি বর্তমান পর্যবেক্ষণে স্বীকৃত।

বাংলাদেশে “নাসুটা” নামটি দীর্ঘদিনের চেনা হলেও, বৈজ্ঞানিক সত্য আজ বলছে—আমাদের দেশে যেসব ভাইন স্নেক আছে, তাদের পরিচয় আলাদা। এই হালনাগাদ ধারণা শুধু নামের সংশোধন নয়, সংরক্ষণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ; কোন এলাকায় কোন প্রজাতি আছে—এটা স্পষ্ট না হলে সুরক্ষার কৌশলও পরিষ্কার হয় না। তাই স্থানীয় রেকর্ডের পুনর্মূল্যায়ন, বন-ঝোপঝাড় রক্ষা, কীটনাশক কমানো এবং জনসচেতনতা—সব মিলিয়ে ভাইন স্নেকের টিকে থাকার লড়াই অনেকটাই সহজ হতে পারে।

জনপ্রিয় সংবাদ

‘সুইম শেডি’ নাম নিয়ে আইনি লড়াইয়ে এমিনেম

আহেটুল্লা নাসুটা বা ভাইন স্নেক: বাংলাদেশে ‘নাসুটা’ ও বাংলায় লাউ ডগা সাপ

০৪:০০:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫

আহেটুল্লা নাসুটা (Ahaetulla nasuta) দক্ষিণ এশিয়ার অতি চেনা ভাইন স্নেক বা ‘লতা সাপ’-এর এক নাম, যার খ্যাতি তার অবিশ্বাস্য সরু, সবুজ শরীর আর ঝুলন্ত ডালের মতো ছদ্মবেশের জন্য। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বড় এক সংশোধন এসেছে: আজকের হিসাবে Ahaetulla nasuta মূলত শ্রীলঙ্কার স্থানিক প্রজাতি; ভারত-বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের যেসব সাপকে আগে “নাসুটা” বলা হতো, তার বেশিরভাগকেই আলাদা প্রজাতি হিসেবে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই “নাসুটা” নামটি ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হলেও, বর্তমান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে আমাদের দেশে যে ভাইন স্নেকগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো অন্য প্রজাতির অন্তর্গত।

আহেটুল্লা নাসুটার বর্তমান বিস্তৃতি

নতুন ট্যাক্সোনমিক পর্যালোচনার (২০২০) পর Ahaetulla nasuta কেবল শ্রীলঙ্কাতেই সীমাবদ্ধ বলে ধরা হয়। আগে যাকে ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে পাওয়া যেত বলা হতো, তা আর প্রযোজ্য নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন জুটাক্সায় প্রকাশিত গবেষণার ভিত্তিতে গৃহীত।

বাংলাদেশে ‘নাসুটা’ নামের ঐতিহাসিক ব্যবহার ও আজকের বাস্তবতা

বাংলাদেশে বহু বছর “পাতি লাউডগা” বা “পঙ্খিরাজ” নামে যেটিকে লোকমুখে “নাসুটা” বলা হতো, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে—এসব রেকর্ড মূলত Ahaetulla anomala (ভ্যারিয়েবল কালার্ড ভাইন স্নেক) ও Ahaetulla prasina (ওরিয়েন্টাল হুইপ স্নেক/এশিয়ান ভাইন স্নেক)-এর সঙ্গে মিলে। অর্থাৎ, নামটি চলতি ভাষায় থেকে গেলেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিকভাবে থাকা ভাইন স্নেকগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে “নাসুটা” নয়। A. anomala এবং A. prasina—দুটোরই বিতরণে বাংলাদেশ রয়েছে।

বাংলাদেশে কোন কোন এলাকায় মিলত/মেলে

বাংলাদেশের আর্দ্র অরণ্য, চিরসবুজ/অর্ধচিরসবুজ বনাঞ্চল, বাগান-উপবন ও জলাশয়ের ধারঘেঁষা গাছপালায় ভাইন স্নেক দেখা যায়। দেশের ভৌগোলিক রেকর্ড ও নিকটবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ধারাবাহিক আবাসভিত্তিক প্রমাণ বিবেচনায়—সিলেটের চা-বাগান ও আর্দ্র বনভূমি, চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলার বনাঞ্চল, উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের ঝোপঝাড়ময় এলাকা—এসব জোনে ইতিহাসগতভাবে এই সাপের উপস্থিতি নথিবদ্ধ হয়েছে বা হতে পারে। তাছাড়া বাদামি রঙের ঘন দাগযুক্ত ভাইন স্নেক (পূর্বে A. pulverulenta নামে উদ্ধৃত; বর্তমানে শ্রীলঙ্কা-নির্দিষ্ট বলেই ধরা হয়) নিয়ে উত্তর-পশ্চিমের নওগাঁ-রাজশাহী অঞ্চলে একবার ছবি-ভিত্তিক উল্লেখ আছে; তবে নতুন ট্যাক্সোনমি প্রেক্ষিতে এমন রেকর্ডের প্রজাতি-পরিচয় পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে।

সংখ্যা: আগে কেমন ছিল, এখন কেমন

লোকালয়ে কম চোখে পড়লেও, ঝোপাল-আর্দ্র বনাঞ্চলে আগে তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যেত—বিশেষ করে চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে। কারণ, এসব সাপ দিবাচর ও বৃক্ষবাসী; মানুষের চোখ এড়ানো তাদের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার কৌশল। সাম্প্রতিক দশকে বনভূমি সংকোচন, ঝোপঝাড় পরিষ্কার, কীটনাশক ব্যবহার, এবং পোষ্য প্রাণী (বিড়াল ইত্যাদি)-জনিত চাপ বাড়ায় সম্ভাব্য আবাসক্ষেত্র ক্ষুদ্রকায় হয়েছে। ফলে ক্ষেত্র-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণে উপস্থিতি কমে এসেছে বলে স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমীদের অভিজ্ঞতায় উঠে আসে। সরকারি জাতীয় তালিকায় এই একক প্রজাতি হিসেবে পৃথক জনসংখ্যা-শুমারির নির্ভরযোগ্য প্রকাশ্য তথ্য সীমিত; কিন্তু আঞ্চলিক আবাসভিত্তিক সংকোচনের দিকটি সুপ্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশে এখন কোন কোন প্রজাতি দেখা যায়

১) Ahaetulla anomala — ভ্যারিয়েবল কালার্ড ভাইন স্নেক; বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশেই নথিবদ্ধ।
২) Ahaetulla prasina — ওরিয়েন্টাল/এশিয়ান ভাইন স্নেক; বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত।

ট্যাক্সোনমি আপডেট: কেন ‘নাসুটা’ নামটি বদলে গেল

২০২০ সালে মালিক ও সহগবেষকদের বড় এক পর্যালোচনায় দেখা যায়—দীর্ঘদিন “A. nasuta কমপ্লেক্স” বলে যেটা ধরা হতো, সেটি আসলে কয়েকটি আড়ালে থাকা (cryptic) প্রজাতির সমষ্টি। ফলে শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা ‘নাসুটা’ নামে থেকে গেলেও, উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ডের অনেক ‘নাসুটা’ রেকর্ডকে অন্য নাম (যেমন A. oxyrhyncha, A. anomala, A. borealis, A. farnsworthi, A. malabarica, A. travancorica, A. sahyadrensis ইত্যাদি) দেওয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে “বাংলাদেশে নাসুটা” কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে আর প্রযোজ্য নয়।

রূপ-লক্ষণ ও আচরণ (ভাইন স্নেকগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য)

ভাইন স্নেকের শরীর লতাগুল্মের মতো সরু ও দীর্ঘ; লেজ লম্বা; মাথা ত্রিভুজাকৃতি ও সামনের দিকে তীক্ষ্ণ। চোখ বড় এবং কী-হোল আকৃতির অনুভূমিক পিউপিল—যা সরীসৃপে বিরল বৈশিষ্ট্য। রং সাধারণত উজ্জ্বল সবুজ, তবে হলুদ/ধূসর/বাদামি ভাবও দেখা যায়—বিশেষ করে A. anomala-তে রঙের তারতম্য উল্লেখযোগ্য। ডালে-ডালে স্থির হয়ে দুলতে দুলতে ছদ্মবেশ নেওয়া ও ধীরে শিকার ধরা এদের কৌশল।

খাদ্যাভ্যাস

প্রধানত টিকটিকি ও গিরগিটি—এদের প্রিয় শিকার। জলাশয়ের ধারেকাছে থাকলে ব্যাঙও খায়। ডালে ঝুলে থেকে ধীর গতিতে ঘনিয়ে এসে আকস্মিক কামড়ে শিকার ধরতে দক্ষ।

বিষধরতা ও মানুষের জন্য ঝুঁকি

আহেটুল্লা গণের সাপগুলো ‘রিয়ার-ফ্যাংড’ বা পশ্চ-দন্তবিশিষ্ট। ডুভেরনোয়ের গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিষ শিকারকে অসাড় করতে সাহায্য করলেও, মানুষের জন্য সাধারণত গুরুতর চিকিৎসাজনিত জটিলতা তৈরি করে না—স্থানীয় ব্যথা, ফোলা বা ঝিনঝিনে অনুভূতি তৈরি হতে পারে। সতর্কতা জরুরি হলেও আতঙ্কের কারণ নয়।

প্রজনন

বেশিরভাগ ভাইন স্নেক ওভোভিভিপ্যারাস—অর্থাৎ ডিম মায়ের দেহেই বিকশিত হয়ে শাবক হিসেবে বাইরে আসে। আর্দ্র ও উষ্ণ বনভূমি—এদের জন্য উপযোগী পরিবেশ।

সংরক্ষণ অবস্থা ও হুমকি

আবাসস্থল সংকোচন—বনভূমি নিধন, ঝোপঝাড় পরিষ্কার, কীটনাশক—এগুলো বড় হুমকি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নগর-প্রান্তের বাগান/উপবনে গাছ কাটাছাঁটা ও পোষ্য বিড়ালের শিকারচাপও বিবেচ্য। আঞ্চলিকভাবে সচেতনতা, বাস্তুগত করিডর রক্ষা, এবং বাগান-বনায়নে ঝোপঝাড় রক্ষা—এসব পদক্ষেপ ভাইন স্নেকের টিকে থাকায় সহায়ক হবে। প্রজাতিভেদে বৈশ্বিক আইইউসিএন মূল্যায়ন ভিন্ন; A. prasina সাধারণত বিস্তৃত ও সাধারণ, A. anomala-ও এখনো গুরুতর ঝুঁকিতে ধরা হয় না।

“কতগুলো প্রজাতি”—আহেটুল্লা গণে প্রজাতি সংখ্যা

আহেটুল্লা গণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক নতুন প্রজাতি বর্ণিত হয়েছে ও পুরোনো ধারণা সংশোধিত হয়েছে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের তালিকায় সংখ্যাটি আলাদা হতে দেখা যায়—কেউ ১৮টির মতো, কেউবা ২০-এর বেশি বলছে; ২০২৪–২৫ সালের সংকলনে ১৮–২১টির মধ্যে ওঠানামা করছে। কাজেই নিরাপদভাবে বলা যায়, বর্তমানে আহেটুল্লা গণে প্রায় ১৮–২১টি প্রজাতি স্বীকৃত বা প্রস্তাবিত রয়েছে, এবং শ্রীলঙ্কা ও ভারতের পশ্চিমঘাট—দুটি ‘হটস্পট’ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ

১) “Ahaetulla nasuta” এখন শ্রীলঙ্কার স্থানিক প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়; বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে থাকা ভাইন স্নেকগুলোকে আগে নাসুটা বলা হলেও, নতুন ট্যাক্সোনমি অনুযায়ী সেগুলো মূলত A. anomala ও A. prasina।
২) বাংলাদেশের সম্ভাব্য/নথিবদ্ধ অঞ্চল—সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি, এবং বাগান-উপবনসমৃদ্ধ আর্দ্র আবাসস্থল; উত্তর-পশ্চিমে একসময় ‘বাদামি’ ভাইন স্নেক ধরনের ছবি-ভিত্তিক উল্লেখ আছে, তবে প্রজাতি-পরিচয় এখন পুনর্মূল্যায়নসাপেক্ষ।
৩) জনসংখ্যা: লোকালয়ে বিরল; আবাসক্ষেত্র সংকোচন ও কীটনাশক ব্যবহারের চাপে প্রত্যক্ষ দেখা কমেছে বলে স্থানীয় ক্ষেত্র-অভিজ্ঞতায় ইঙ্গিত।
৪) প্রজাতি সংখ্যা: আহেটুল্লা গণে মোটামুটি ১৮–২১টি প্রজাতি বর্তমান পর্যবেক্ষণে স্বীকৃত।

বাংলাদেশে “নাসুটা” নামটি দীর্ঘদিনের চেনা হলেও, বৈজ্ঞানিক সত্য আজ বলছে—আমাদের দেশে যেসব ভাইন স্নেক আছে, তাদের পরিচয় আলাদা। এই হালনাগাদ ধারণা শুধু নামের সংশোধন নয়, সংরক্ষণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ; কোন এলাকায় কোন প্রজাতি আছে—এটা স্পষ্ট না হলে সুরক্ষার কৌশলও পরিষ্কার হয় না। তাই স্থানীয় রেকর্ডের পুনর্মূল্যায়ন, বন-ঝোপঝাড় রক্ষা, কীটনাশক কমানো এবং জনসচেতনতা—সব মিলিয়ে ভাইন স্নেকের টিকে থাকার লড়াই অনেকটাই সহজ হতে পারে।