০৫:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
মাদারল্যান্ড কখনো ভোলে না’ বীরকে —তাইওয়ানে গোপন মিশনে শহীদ উউ শিকে স্মরণ করছে চীন বার্নার্ড জুলিয়ানের করুণ জীবন— যার উত্থান ও পতন সমান নাটকীয় ১৯২৯—যে বছরে ভেঙে পড়েছিল আমেরিকার স্বপ্ন নগদহীন পেমেন্ট ভালো—কিন্তু সেটি ব্যর্থ হলে সমস্যা মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-৩৫৭) হংকং বাজারে সানি হেভি ইন্ডাস্ট্রির শেয়ার বিক্রি শুরু বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড বাণিজ্য সহযোগিতা জোরদারে বিএফটিআই ও আইটিডি’র মধ্যে সমঝোতা স্মারক রাজনৈতিক বিভাজন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ: গণভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা- আসিফ নজরুল সৎপুত্রের হাতে আহত নারী ঢাকায় মারা গেলেন ঝিনাইদহে নবগঙ্গা নদীতে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাপানি নারীদের সংগ্রাম: অস্ট্রেলিয়ায় বিয়ের পর বৈষম্যের মুখোমুখি

যুদ্ধ-পরবর্তী বিবাহ এবং অভিবাসন


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর সেনাদের অনেকেই স্থানীয় নারীদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মধ্যে ছিলেন ওসাকা প্রদেশে জন্ম নেওয়া আকিকো হিরানো, যিনি পরবর্তীতে আকিকো কার্কহাম নামে পরিচিত হন। তিনি হিরোশিমায় একটি গোলাবারুদের কারখানায় কাজ করতেন। যুদ্ধ শেষ হলে কুরে শহরে মিত্রবাহিনীর দপ্তরে টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি নেন। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় অস্ট্রেলীয় সেনা গ্লেন কার্কহামের সঙ্গে, যিনি বয়সে ১৮ বছর বড় ছিলেন। দু’জনের বিয়ে হয় এবং ১৯৫৩ সালে আকিকো তাঁর স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। প্রায় ৬৫০ জন জাপানি নারী একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন করেছিলেন।

সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতি ও বৈষম্য


সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে এলেও “হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া পলিসি” চালু ছিল। এ নীতি ইউরোপীয় নন-অভিবাসীদের প্রবেশে কঠোর বাধা তৈরি করেছিল। জাপানিদের ‘শত্রু বিদেশি’ হিসেবে দেখা হতো এবং স্থানীয় সমাজে তাদের সন্দেহ ও বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হতো। আকিকো নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন। তিনি অস্ট্রেলীয় সমাজে মিশে যেতে ‘এলসা’ নামে একটি ইংরেজি নাম ব্যবহার করতেন। আট বছর পর তিনি নাগরিকত্ব পান।

পারিবারিক জীবন ও সংগ্রাম


আকিকো ও গ্লেন কার্কহামের চার সন্তান ছিল। তারা ব্রিসবেন ও ক্যানবেরা-সহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। তৎকালীন অস্ট্রেলীয় সমাজে যুদ্ধের স্মৃতি, বিশেষ করে ১৯৪২ সালে জাপানি বাহিনীর ডারউইন বোমাবর্ষণ, তখনো তাজা ছিল। ফলে অস্ট্রেলীয় ও জাপানি দম্পতিদের বিবাহ অনেকের কাছে অস্বস্তিকর মনে হতো।

আকিকোর মেয়ে চেহারার কারণে স্কুলে হেনস্তার শিকার হন। পরিবারের সুরক্ষার জন্য গ্লেন দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেও আকিকো জাপানি ভাষা ব্যবহার এড়িয়ে চলতেন এবং ব্রিটিশ ধাঁচের খাবার রান্না করতেন। অনেকে মানসিক চাপ ও নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যাও করেন বলে জানা যায়।

কাজ ও আত্মপরিচয়

সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব কমে এলে আকিকো আবার টাইপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি নিভৃতে জাপানি ভাষার পাঠ্যবই তৈরিতে সহায়তা করতেন। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে “হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া” নীতি বাতিল করে বহুসাংস্কৃতিক নীতি গ্রহণ করে। এই পরিবর্তন আকিকোর জন্য মুক্তির অনুভূতি নিয়ে আসে। এরপর তিনি গোল্ড কোস্টে পর্যটন শিল্পে দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং জাপান-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে ভূমিকা রাখেন। ২০২২ সালে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেন, বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

উত্তরাধিকার ও নতুন প্রজন্ম


আকিকোর নাতনি ৩৮ বছর বয়সী শিল্পী এলিশা রেই, তাঁর গল্প তুলে ধরছেন নতুন প্রজন্মের সামনে। তিনি নিক্কেই অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি হিসেবে জাপানি-অস্ট্রেলীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে কাজ করছেন। রেই জানান, তাঁর দাদি ছিলেন প্রাণবন্ত, কৃতজ্ঞ এবং ইতিবাচক মানুষ।

ক্যালিগ্রাফি ও কালি-চিত্রকলায় দাদির চর্চা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে রেই নিজেও শিল্পী হন। গবেষণায় তিনি দেখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ৪ হাজার জাপানি শ্রমিককে অস্ট্রেলিয়া থেকে আটক ও বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাদের অনেকেই আখচাষ ও মুক্তা আহরণের মতো নিম্ন আয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

শিল্পকর্মে ইতিহাসের চিত্র


২০২৫ সালের জুন-জুলাই মাসে রেই টাউনসভিলে একটি শিল্প প্রদর্শনী করেন। সেখানে ওয়াশি নামে ঐতিহ্যবাহী জাপানি কাগজ ব্যবহার করে মুক্তা আহরণসহ নানা শ্রমজীবী জাপানি অভিবাসীদের জীবনচিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর লক্ষ্য, এই ইতিহাস কেবল জানানো নয়, বরং মানুষকে তা আবেগ দিয়ে অনুভব করানো।

জনপ্রিয় সংবাদ

মাদারল্যান্ড কখনো ভোলে না’ বীরকে —তাইওয়ানে গোপন মিশনে শহীদ উউ শিকে স্মরণ করছে চীন

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাপানি নারীদের সংগ্রাম: অস্ট্রেলিয়ায় বিয়ের পর বৈষম্যের মুখোমুখি

০১:৫৪:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫

যুদ্ধ-পরবর্তী বিবাহ এবং অভিবাসন


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর সেনাদের অনেকেই স্থানীয় নারীদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মধ্যে ছিলেন ওসাকা প্রদেশে জন্ম নেওয়া আকিকো হিরানো, যিনি পরবর্তীতে আকিকো কার্কহাম নামে পরিচিত হন। তিনি হিরোশিমায় একটি গোলাবারুদের কারখানায় কাজ করতেন। যুদ্ধ শেষ হলে কুরে শহরে মিত্রবাহিনীর দপ্তরে টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি নেন। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় অস্ট্রেলীয় সেনা গ্লেন কার্কহামের সঙ্গে, যিনি বয়সে ১৮ বছর বড় ছিলেন। দু’জনের বিয়ে হয় এবং ১৯৫৩ সালে আকিকো তাঁর স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। প্রায় ৬৫০ জন জাপানি নারী একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন করেছিলেন।

সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতি ও বৈষম্য


সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে এলেও “হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া পলিসি” চালু ছিল। এ নীতি ইউরোপীয় নন-অভিবাসীদের প্রবেশে কঠোর বাধা তৈরি করেছিল। জাপানিদের ‘শত্রু বিদেশি’ হিসেবে দেখা হতো এবং স্থানীয় সমাজে তাদের সন্দেহ ও বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হতো। আকিকো নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন। তিনি অস্ট্রেলীয় সমাজে মিশে যেতে ‘এলসা’ নামে একটি ইংরেজি নাম ব্যবহার করতেন। আট বছর পর তিনি নাগরিকত্ব পান।

পারিবারিক জীবন ও সংগ্রাম


আকিকো ও গ্লেন কার্কহামের চার সন্তান ছিল। তারা ব্রিসবেন ও ক্যানবেরা-সহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। তৎকালীন অস্ট্রেলীয় সমাজে যুদ্ধের স্মৃতি, বিশেষ করে ১৯৪২ সালে জাপানি বাহিনীর ডারউইন বোমাবর্ষণ, তখনো তাজা ছিল। ফলে অস্ট্রেলীয় ও জাপানি দম্পতিদের বিবাহ অনেকের কাছে অস্বস্তিকর মনে হতো।

আকিকোর মেয়ে চেহারার কারণে স্কুলে হেনস্তার শিকার হন। পরিবারের সুরক্ষার জন্য গ্লেন দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেও আকিকো জাপানি ভাষা ব্যবহার এড়িয়ে চলতেন এবং ব্রিটিশ ধাঁচের খাবার রান্না করতেন। অনেকে মানসিক চাপ ও নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যাও করেন বলে জানা যায়।

কাজ ও আত্মপরিচয়

সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব কমে এলে আকিকো আবার টাইপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি নিভৃতে জাপানি ভাষার পাঠ্যবই তৈরিতে সহায়তা করতেন। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে “হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া” নীতি বাতিল করে বহুসাংস্কৃতিক নীতি গ্রহণ করে। এই পরিবর্তন আকিকোর জন্য মুক্তির অনুভূতি নিয়ে আসে। এরপর তিনি গোল্ড কোস্টে পর্যটন শিল্পে দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং জাপান-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে ভূমিকা রাখেন। ২০২২ সালে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেন, বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

উত্তরাধিকার ও নতুন প্রজন্ম


আকিকোর নাতনি ৩৮ বছর বয়সী শিল্পী এলিশা রেই, তাঁর গল্প তুলে ধরছেন নতুন প্রজন্মের সামনে। তিনি নিক্কেই অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি হিসেবে জাপানি-অস্ট্রেলীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে কাজ করছেন। রেই জানান, তাঁর দাদি ছিলেন প্রাণবন্ত, কৃতজ্ঞ এবং ইতিবাচক মানুষ।

ক্যালিগ্রাফি ও কালি-চিত্রকলায় দাদির চর্চা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে রেই নিজেও শিল্পী হন। গবেষণায় তিনি দেখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ৪ হাজার জাপানি শ্রমিককে অস্ট্রেলিয়া থেকে আটক ও বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাদের অনেকেই আখচাষ ও মুক্তা আহরণের মতো নিম্ন আয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

শিল্পকর্মে ইতিহাসের চিত্র


২০২৫ সালের জুন-জুলাই মাসে রেই টাউনসভিলে একটি শিল্প প্রদর্শনী করেন। সেখানে ওয়াশি নামে ঐতিহ্যবাহী জাপানি কাগজ ব্যবহার করে মুক্তা আহরণসহ নানা শ্রমজীবী জাপানি অভিবাসীদের জীবনচিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর লক্ষ্য, এই ইতিহাস কেবল জানানো নয়, বরং মানুষকে তা আবেগ দিয়ে অনুভব করানো।