দীর্ঘ বেকারত্বে ভোগা শিক্ষিত কর্মী
কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সাইমন লিয়াং প্রায় ১৮ মাস ধরে বেকার। সামাজিক কাজের একটি এনজিওতে ইভেন্ট সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করলেও বাজেট ৭ শতাংশ কমে যাওয়ায় তার চুক্তি নবায়ন হয়নি। বর্তমানে তিনি খণ্ডকালীন কাজ করে কোনোমতে জীবন চালাচ্ছেন এবং প্রয়োজনে নিরাপত্তারক্ষী বা মুনকেক কারখানার সহকারী হিসেবেও কাজ নিতে প্রস্তুত।
তিনি সম্প্রতি শ্রম দপ্তরের একটি চাকরি মেলায় আরও ৩,২০০ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
বেকারত্বের হারে বৃদ্ধি
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মে-জুলাই সময়ে হংকংয়ের বেকারত্ব বেড়ে ৩.৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ৩৩ মাসে সর্বোচ্চ। এর আগে এপ্রিল-জুনে এ হার ছিল ৩.৫ শতাংশ।
অর্থনীতি যদিও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৩.১ শতাংশ ও প্রথম প্রান্তিকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তবুও কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়েনি।
নাটিক্সিস করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ গ্যারি এনজি বলেন, এটি “চাকরিহীন প্রবৃদ্ধি”। মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বিদ্যমান চাকরির সংখ্যা মহামারির আগের মাত্র ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
চাকরির বিজ্ঞাপন কমছে, প্রতিযোগিতা বাড়ছে
রিক্রুটমেন্ট প্ল্যাটফর্ম Jobsdb জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে চাকরির বিজ্ঞাপন সংখ্যা ২০২৪ সালের শেষার্ধের তুলনায় ৬ শতাংশ কমেছে।
কিন্তু বিজ্ঞাপিত চাকরির জন্য আবেদন বেড়েছে ৪১ শতাংশ, যা কর্মসংস্থানের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের কারণে নিয়োগে সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে।
খাতভেদে বেকারত্বের প্রবণতা
খাদ্য ও পানীয় খাত: জুন ২০২৩-এ বেকারত্ব ছিল ৪.৮ শতাংশ, বর্তমানে বেড়ে ৬.৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
খুচরা বাণিজ্য: ৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ শতাংশ।
নির্মাণ খাত: ৪.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭.২ শতাংশ, সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
উচ্চশিক্ষিত কর্মী: বেকারত্ব ২.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.৪ শতাংশ।
ম্যানেজার পর্যায়: ১.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২.২ শতাংশ।
শ্রম খাতের আইনপ্রণেতা চাউ সিউ-চুং জানান, নির্মাণ ও ক্যাটারিং খাতে শিগগিরই বেকারত্বের চাপ বাড়তে পারে।
চীনে বাসিন্দাদের খরচ বৃদ্ধি, ভ্রমণকারীদের ব্যয়ের ধরণ বদল এবং খাবার অর্ডারে প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ক্যাটারিং খাতে কর্মসংস্থান এক বছরে ২.২ শতাংশ কমেছে।
নির্মাণ খাতে সংকট
অস্থির সম্পত্তি বাজারের কারণে ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ব্যক্তিগত নির্মাণ সাইটে কাজের মোট মূল্য আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশের বেশি কমেছে।
ফলে নির্মাণশিল্পে শ্রমের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে।
এআই ও প্রযুক্তির প্রভাব
শ্রম উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য রিকি চান বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিবেশে নিয়োগে দ্বিধায় ভুগছে।
দীর্ঘমেয়াদে এআই ব্যবহার করে কর্মী বদলানোর পরিকল্পনা থাকলেও প্রয়োজনীয় মূলধনী বিনিয়োগের কারণে এটি এখনও ব্যাপকভাবে কার্যকর হয়নি।
হ্যাং স্যাং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক রয় ইয়িং বলেন, ফাইন্যান্স ও ব্যাংক খাতে এআই বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। ফলে তথ্যপ্রবেশ, গ্রাহকসেবা এবং খুচরা বিক্রির মতো চাকরি সহজেই প্রযুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে। তবে একইসঙ্গে এআই, ফিনটেক ও বিগ ডেটা খাতে নতুন চাকরিও তৈরি হচ্ছে।
দক্ষতা উন্নয়নের পরামর্শ
রয় ইয়িং জোর দিয়ে বলেন, দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে কর্মীদের আজীবন শেখার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
কুরসেরা ও লিঙ্কডইন লার্নিংয়ের মতো মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়ালসের মাধ্যমে নতুন দক্ষতা অর্জন এবং সরকার পরিচালিত কন্টিনিউয়িং এডুকেশন ফান্ড ও এমপ্লয়িজ রিট্রেনিং বোর্ড ব্যবহার করা উচিত।
সরকারের উদ্যোগ
শ্রম দপ্তর জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে তারা ১২টি বড় চাকরি মেলা আয়োজন করেছে। এতে ২৬৭টি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে ১৫ হাজার শূন্যপদ প্রদর্শিত হয় এবং ২২ হাজারের বেশি চাকরিপ্রার্থী অংশ নেয়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ: হংকং বনাম বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমবাজার
হংকংয়ের বেকারত্ব বৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ হলো—অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক বাণিজ্য চাপ, ভোক্তাদের ব্যয়ের ধরণ বদল, এবং এআই প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহার। তুলনায় বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ দেখা যায়।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে বেকারত্বের মূল সমস্যা হলো চাকরির পরিমাণের তুলনায় কর্মক্ষম জনশক্তির অতিরিক্ত চাপ। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, কিন্তু পর্যাপ্ত শিল্পায়ন ও নতুন চাকরি সৃষ্টির অভাবে প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
তবে হংকংয়ের মতো প্রযুক্তি-নির্ভর চাকরি হারানোর প্রবণতা বাংলাদেশে এখনো সীমিত। বাংলাদেশের শিল্পখাত মূলত তৈরি পোশাক, কৃষি, চামড়া ও শ্রমঘন সেক্টরে নির্ভরশীল। এই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে ধীর, তাই স্বল্পমেয়াদে সরাসরি এআই-ভিত্তিক চাকরি সংকট তৈরি হয়নি।
ভারত
ভারতে প্রযুক্তি খাত দ্রুত প্রসারিত হলেও, একইসঙ্গে বেকারত্বের চাপও তীব্র। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ঘাটতি প্রকট। হংকংয়ের মতো এআই এখানে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, ফলে কলসেন্টার, ব্যাংকিং ও কাস্টমার সার্ভিস খাত সবচেয়ে ঝুঁকিতে।
পাকিস্তান ও নেপাল
এই দুই দেশে কর্মসংস্থান সংকট আরও ভিন্ন। শিল্পখাত দুর্বল হওয়ায় বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তি বিদেশে প্রবাসী হিসেবে কাজ করছে। প্রবাসী আয় জাতীয় অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখলেও স্থানীয় চাকরির বাজার সংকীর্ণই থেকে গেছে। হংকংয়ের তুলনায় এখানে প্রযুক্তির প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম হলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্বল অর্থনীতি কর্মসংস্থান সঙ্কটকে গভীর করছে।
মিল ও অমিল
মিল: হংকং ও দক্ষিণ এশিয়া উভয় অঞ্চলে তরুণ ও উচ্চশিক্ষিত কর্মীদের চাকরি সংকটে পড়তে হচ্ছে।
অমিল: হংকংয়ে মূল সমস্যা এআই ও প্রযুক্তির প্রতিস্থাপন, আর বাংলাদেশ-দক্ষিণ এশিয়ায় মূল চ্যালেঞ্জ হলো সীমিত শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি।
ভবিষ্যৎ শিক্ষা
হংকংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য শিক্ষা হলো—আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে প্রযুক্তির প্রভাব মোকাবেলায়।
আজীবন শিক্ষার সংস্কৃতি, মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়ালস, এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি যদি এখনই গুরুত্ব না পায়, তবে আগামী দশকে এআই ও অটোমেশন এই অঞ্চলেও ব্যাপক চাকরি সংকট তৈরি করতে পারে।
এআই ও অনিশ্চিত অর্থনীতি: হংকংয়ের বেকারত্ব সংকট ও দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ০২:৪৮:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
- 38
জনপ্রিয় সংবাদ



















