জীবনের সময় বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসার ছায়া রয়ে যাচ্ছে
৩১ বছর বয়সে গোয়েন ওরিলিওর চতুর্থ ধাপের ফুসফুস ক্যান্সার ধরা পড়ে। রোগ তখনই তার চোখে ছড়িয়ে পড়েছিল। অবসরের জন্য কোনো সঞ্চয় রাখার মতো সময় বা আশা তখন তার ছিল না। কিন্তু এক দশক পরও তিনি বেঁচে আছেন, যদিও এখনও মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সারে ভুগছেন।
গোয়েন বারবার চিকিৎসা পদ্ধতি পরিবর্তন করেছেন—কেমোথেরাপি থেকে শুরু করে একের পর এক নতুন ওষুধে। এসব চিকিৎসা তাকে স্থায়ীভাবে সুস্থ করছে না, তবে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছরের জীবন বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার নিজের ভাষায়, “আমার স্লোগান হলো — বিজ্ঞান যেন সবসময় আমার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকে।”
দীর্ঘমেয়াদি ক্যান্সার: নতুন বাস্তবতা
গোয়েন ওরিলিও আসলে এমন এক নতুন যুগের অংশ, যেখানে ক্যান্সার মানেই কেবল মৃত্যু নয়, বরং এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো। এক সময় যে ক্যান্সার ধরা পড়লেই দ্রুত মৃত্যুর শঙ্কা ছিল, এখন সেখানে নতুন চিকিৎসা মানুষকে অনেক দীর্ঘ সময় বাঁচার সুযোগ দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১ কোটি ৮০ লাখের বেশি ক্যান্সার বেঁচে থাকা মানুষ আছেন, যা মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি। ২০৪০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ। শুধু ২০২৫ সালেই অনুমান করা হচ্ছে, সাধারণ ছয় ধরনের ক্যান্সারের (মেলানোমা, স্তন, মূত্রথলি, কোলোরেক্টাল, প্রোস্টেট ও ফুসফুস)এর মধ্যে চতুর্থ ধাপ বা মেটাস্ট্যাটিক অবস্থায় ৬ লাখ ৯০ হাজার মানুষ বেঁচে থাকবেন।
চিকিৎসা ও গবেষণার অগ্রগতি
নতুন ওষুধগুলো ক্যান্সারের জিনগত পরিবর্তনকে লক্ষ্য করছে বা রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। যেমন—স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় হারসেপটিন বা লিউকেমিয়ায় গ্লিভেক, আর ইমিউনোথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। কিট্রুডা নামের ওষুধটি এখন বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধগুলোর একটি, যা ১৮ ধরনের ক্যান্সারে ব্যবহার হচ্ছে।
ফুসফুস ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগেও উন্নতি দেখা যাচ্ছে। ২০০৪ সালে যেখানে উন্নত স্তরের ফুসফুস ক্যান্সারে পাঁচ বছরের বেঁচে থাকার হার ছিল মাত্র ৩.৭ শতাংশ, সেখানে ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.২ শতাংশে।
রোগীর বাস্তব জীবন ও নতুন চ্যালেঞ্জ
গোয়েনের মতো অনেক রোগীর জীবন এখন নতুন এক ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় চলছে। প্রতি ১২ সপ্তাহ অন্তর স্ক্যান করাতে হয় তাকে—যার ফলাফলের অপেক্ষাকে ডাক্তাররা “স্ক্যানজাইটি” নামে ডাকেন। প্রতিবার পরীক্ষা শেষে যদি ফল ভালো আসে, তখন তিনি আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেষ্টা করেন।
গোয়েনের ক্যান্সারে ROS1 নামক বিরল জিনগত পরিবর্তন ধরা পড়ে, যার ফলে তিনি লক্ষ্যভিত্তিক ওষুধে সাড়া দিতে শুরু করেন। কেমোথেরাপির পর তিনি ক্রিজোটিনিব, পরে লরলাটিনিব সহ বিভিন্ন পরীক্ষামূলক ওষুধ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি জাইডেসামটিনিব নিচ্ছেন, যা তাকে তিন বছর ধরে স্থিতিশীল রেখেছে।
চিকিৎসার বাইরে মানসিক ও অর্থনৈতিক লড়াই
দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা কেবল শারীরিক কষ্টই নয়, অর্থনৈতিক চাপও তৈরি করছে। নিয়মিত স্ক্যান, ওষুধ ও চিকিৎসার খরচ মিলিয়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়। গোয়েনের সহকর্মীরা একসময় তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু বার্ষিক ৫ হাজার ডলারের কো-পে ধীরে ধীরে সেই সঞ্চয় ফুরিয়ে এসেছে।
এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনেও ক্যান্সার ছাপ রেখে গেছে। চিকিৎসার কারণে তিনি আর সন্তান নিতে পারেননি, যদিও পরিবার বড় করার পরিকল্পনা ছিল। এখন তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে তিনি জীবনের ভবিষ্যৎ কল্পনা করেন—কখনও অবসরের স্বপ্ন দেখেন, আবার কখনও মনে করেন এত টাকা সঞ্চয় করেই বা কী লাভ।
বেঁচে থাকার অর্থ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত
ডাক্তাররা বলছেন, ক্যান্সার এখন আর কেবল “বাঁচা বা মরা” র মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি অনেকের জন্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো, যেখানে চিকিৎসা চলতে থাকে, জীবনও চলতে থাকে।
গোয়েন নিজেও তার শিক্ষার্থীদের কাছে এক নতুন বার্তা দিতে চান—চতুর্থ ধাপের ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। তিনি এখনো ক্লাস নেন, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ দেন, মেয়ের সঙ্গে ভ্রমণে যান। “স্মৃতি তৈরি করাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,” বললেন গোয়েন।
গ্রীষ্মকালে পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে তিনি আবারও তার ‘ক্যান্সারমুক্ত’ দিনের আনন্দ উপভোগ করেছেন। তবে সেপ্টেম্বর আবারও স্ক্যানের তারিখ ঘনিয়ে আসছে। জীবন যেন ক্রমাগত আশা আর শঙ্কার মাঝেই থেমে নেই, বরং চলতে থাকে