পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
সি-গাভী বা সি কাউ (Sea Cow) হলো সমুদ্রের এক রহস্যময়, শান্ত ও ধীরগতিসম্পন্ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডুগং (Dugong dugon)। নামকরণের কারণ হলো এর শরীরের গঠন ও খাদ্যাভ্যাস। গাভীর মতো গোলাকার দেহ, সমুদ্রের ঘাস খাওয়ার অভ্যাস এবং ধীর আচরণ একে ‘সি-গাভী’ হিসেবে পরিচিত করেছে। এদের দেহ দৈর্ঘ্যে সাধারণত ২.৫ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত হয়, আর ওজন ২৫০ থেকে ৪০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। শরীর চর্বির স্তরে আচ্ছাদিত থাকে যা তাদের ঠান্ডা পানিতে টিকে থাকতে সহায়তা করে। ধূসর রঙের চামড়া, ছোট মাথা, এবং চ্যাপ্টা লেজ এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বিস্তৃতি ও আবাসস্থল
সি-গাভীর বিস্তৃতি মূলত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়া ও মাদাগাস্কার পর্যন্ত এই প্রাণী পাওয়া যায়। তারা অগভীর সমুদ্রের সেইসব জায়গায় বাস করে যেখানে প্রচুর সীগ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস পাওয়া যায়। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, উপকূলীয় জোয়ারভাটা অঞ্চল এবং লেগুন তাদের বসবাসের জন্য আদর্শ।

খাদ্যাভ্যাস ও আচরণ
সি-গাভী সম্পূর্ণ উদ্ভিদভোজী প্রাণী। তারা সমুদ্রের তলদেশে জন্মানো সীগ্রাস খেয়ে বেঁচে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক সি-গাভী দিনে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কেজি সীগ্রাস খেতে পারে। তারা সাধারণত একা একা থাকে, তবে কখনও কখনও জোড়ায় বা ছোট দলে চলাফেরা করে। তাদের আচরণ অত্যন্ত শান্ত, আক্রমণাত্মক নয়। শ্বাস নিতে পানির ওপরে উঠতে হয়, তবে একবার শ্বাস নিয়ে ৬ মিনিট পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে পারে।
প্রজনন ও আয়ু
সি-গাভীর প্রজনন প্রক্রিয়া অনেক ধীর। স্ত্রী সি-গাভী প্রায় ৩ থেকে ৭ বছর পরপর একবার বাচ্চা দেয় এবং একবারে কেবল একটি শাবক জন্মায়। শাবকটি মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয় এবং প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে থাকে। এই ধীর প্রজনন প্রক্রিয়ার কারণে এদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় না। একটি সি-গাভী গড়ে ৫০ থেকে ৭০ বছর বাঁচতে পারে, তবে নিরাপদ পরিবেশে তারা আরও দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সি-গাভীর একটি বিখ্যাত প্রজাতি ছিল “স্টেলারের সি কাউ” (Steller’s Sea Cow)। এটি উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে বিশেষ করে রাশিয়ার কাছাকাছি এলাকায় পাওয়া যেত। ১৭৪১ সালে জার্মান প্রকৃতিবিদ জর্জ উইলহেল্ম স্টেলার প্রথম এ প্রাণীটির বর্ণনা দেন। কিন্তু মানুষের শিকার, মাংস ও চর্বির প্রতি অতিরিক্ত লোভের কারণে আবিষ্কারের মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই প্রজাতিটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে কেবল ডুগং-ই একমাত্র সি-গাভীর প্রতিনিধি হিসেবে বেঁচে আছে।
বিপন্নতার কারণ
সি-গাভী আজ বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রাণীর তালিকায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) একে “Vulnerable” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
- অতিরিক্ত মাছ ধরা: সি-গাভী প্রায়ই জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যায়।
- আবাসস্থল ধ্বংস: সীগ্রাসভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়া এদের টিকে থাকার সবচেয়ে বড় হুমকি।
- উপকূলীয় উন্নয়ন: শিল্প-কারখানা, পর্যটন কেন্দ্র, এবং অবকাঠামো নির্মাণ এদের বাসস্থান ধ্বংস করছে।
- দূষণ: প্লাস্টিক, তেল ও রাসায়নিক বর্জ্য সমুদ্র দূষিত করছে, যা সরাসরি এদের খাদ্যভূমি নষ্ট করছে।
- মানুষের শিকার: কিছু দেশে এখনো সি-গাভীর মাংস ও চর্বির জন্য এদের শিকার করা হয়।

সংরক্ষণ উদ্যোগ
সি-গাভী রক্ষায় বিভিন্ন দেশে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
- অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইনে সীগ্রাসভূমি সংরক্ষণের জন্য সামুদ্রিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে।
- ভারত ও শ্রীলঙ্কায় গবেষণা ও জনসচেতনতা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
- আন্তর্জাতিকভাবে CITES (Convention on International Trade in Endangered Species) চুক্তির আওতায় সি-গাভীর বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- বিজ্ঞানীরা জেনেটিক গবেষণা, জিপিএস ট্র্যাকিং এবং স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সি-গাভীর আচরণ ও জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা করছেন।
পরিবেশগত ভূমিকা
সি-গাভী শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং সমুদ্রের পরিবেশগত ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা সীগ্রাসভূমি খেয়ে সেটিকে নতুনভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। এর ফলে অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী যেমন মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও শামুক খাদ্য ও আশ্রয় পায়। এভাবে সি-গাভী সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রাখে।
সি-গাভী পৃথিবীর প্রাচীনতম সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একটি। মানুষের অসচেতনতা, দূষণ ও লোভের কারণে এরা আজ বিলুপ্তির পথে। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে কয়েক দশকের মধ্যেই ডুগং হয়তো স্টেলারের সি-গাভীর মতো ইতিহাসে পরিণত হবে। তাই সি-গাভী রক্ষা করা শুধু একটি প্রাণীকে বাঁচানো নয়, বরং সমুদ্রের সম্পূর্ণ পরিবেশব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















